মাছের কাটা কিনে খাচ্ছে মানুষ। কথাটা শুনতে আজব হলেও এই কথাটাই সত্য। ঢাকার মাছবাজারগুলোতে বড় মাছ কাটার পর মাছের কাঁটার ঠাঁই হতো ময়লার ভাগাড়ে। কিংবা বাড়িতে কুকুর-বিড়াল পোষেন এমন লোকজন সেগুলো চেয়ে নিতেন বিনামূল্যে।
যারা শুধু কাঁটা নিতেন তারা অবশ্য আঁশ, নাড়িভুঁড়ি থেকে বেছে দেওয়ার জন্য যিনি মাছ কাটেন তাকে ২০-৩০ টাকা দিতেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বদলে গেছে সে চিত্র। এখন বড় মাছের কাঁটা, নাড়িভুঁড়ি রীতিমতো ‘চড়া’ দামে বিক্রি হচ্ছে। ঢাকার কম আয়ের মানুষজন ১০০-১২০ টাকা কেজি দরে কিনছেন কাঁটা।
মাছভেদে নাড়িভুঁড়ি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় ভাগায়। অথচ এ দামে কিছুদিন আগেও ভালো মানের এক কেজি মাছ কেনা যেত। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে মাছের দাম বাড়ায় অংশবিশেষ এসব বড় মাছের কাঁটার চাহিদা বেড়েছে। আগে এসব কাঁটা ময়লার ভাগাড়ে গেলেও এখন নিম্ন আয়ের মানুষের নিয়মিত খাবারের অংশ হয়ে উঠেছে। তাই চাহিদা বাড়ায় দিন দিন এসব কাঁটার দামও বাড়ছে।
গত সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, রুই-কাতলা মাছের ভুঁড়ি-চর্বি ভাগা বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। বড় মাছের কাঁটার কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে। আর মাছভেদে ডিমের কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা।
সোমবার কারওয়ান বাজারের মাছ কাটারি বলেন, ‘গত কয়েক বছর মাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ করি। কখনো দেখিনি মাছের কাঁটা বিক্রি হতে। আগে এসব মাছের কাঁটা কেউ চাইলে তাকে কোনো টাকা ছাড়াই দিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু বাজারে মাছের দাম বাড়ায় এর চাহিদা অনেক বেড়েছে। যারা বাড়তি দামে মাছ কিনতে পারছেন না, তারাই মূলত এর ক্রেতা।’
প্রতিদিন কী পরিমাণের চাহিদা থাকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাছের কাঁটা তেমন একটা পাওয়া না গেলেও সময়ের সঙ্গে এসব মাছের কাঁটার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আগে নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষ (কুকুর-বিড়াল পালক) নিলেও এখন অনেকেই নিচ্ছেন। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি খাচ্ছেন এসব মাছের কাঁটা।’
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও ফকিরাপুল বাজারে দুদিন ঘুরে অন্তত ৯-১০ জন ক্রেতাকে মাছের কাঁটা কিনতে দেখা গেছে। ওই দুই বাজারেও প্রতি কেজি মাছের কাঁটা ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী বাজারে এক নারী ক্রেতা বলেন, স্বামীর একার আয় দিয়ে বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে বাজার করার টাকা থাকে না। প্রায় দিনই খাবারের মেনু থাকে ডাল-ভর্তা। কিন্তু বেশ কয়েক মাস সেই আলুও আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
কিছুদিন আগে জানলাম, আলুর দামে মাছের কাঁটা কিনতে পাওয়া যায়। ডালের সঙ্গে বা কোনো সবজির সঙ্গে মাছের কাঁটা দিয়ে একটা পদ হয়ে যায়। সেটা অন্তত আলু ভর্তা থেকেও ভালো। রিকশাচালক বলেন, ‘যা অবস্থা তাতে বউ-ছাওয়াল নিয়ে রিকশার আয়ে আমাগের দিন চলবার নয়। মেলা দিন ইনকাম কম। আগে ভালা ইনকাম হইতো, ছোট পাঙাশের ভাগা কিনতাম।
অহন চাল-ডাল কিনতেই ফুতুর। তাই মাছ কিনবার না পাইরে কম দামে মাছের কাঁটা কিনছি।’ গত বছর ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় অন্যের ফেলে যাওয়া চামড়া বা গিলা-কলিজা বিক্রি হতে দেখা গিয়েছে, যা এখন অনেক নিম্ন আয়ের মানুষের নিত্যকার খাবার তালিকায় থাকছে।
মাছের কাঁটা বিক্রি হওয়ার বিষয়টিকেও বাজারসংশ্লিষ্টরা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার এক বড় কারণ হিসেবে দেখছেন। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘সম্প্রতি মাছের কাঁটা কিংবা অন্যান্য অংশবিশেষ বিক্রি হওয়ার বিষয়টি আমরা লক্ষ করেছি। এর থেকে এটি স্পষ্ট যে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। যদিও সরকার বলছে দেশের ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, অধিক দাম বাড়ার ফলে মানুষ বাজারে গিয়ে মাছ কিনতে পারছে না। অনেকে বাধ্য হয়ে আমিষের চাহিদা পূরণে মাছের কাঁটার দিকে ঝুঁকছেন। নিম্ন আয়ের মানুষ এর ক্রেতা।’ তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে গেল কয়েক বছরে মাছের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। তারপরও বিশ্বে মাছ উৎপাদনে তৃতীয়তে থাকা একটি দেশের জন্য সত্যিকারার্থে লজ্জারও বটে। মাছে-ভাতে বাঙালির জন্য অপমানের।’
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন