খদ্দেরের দেখা নেই, বিলকুল খাঁ খাঁ করছে সোনাগাছি

খদ্দেরের দেখা নেই, বিলকুল খাঁ খাঁ করছে সোনাগাছি

করোনা-সংক্রমণ ঠেকাতে কী করা উচিত, কী উচিত নয়, তা নিয়ে পোস্টার সাঁটিয়েছে প্রশাসন। ভাইরাসের ভয়ে একই ছবি বউবাজার, কালীঘাট, খিদিরপুর, ওয়াটগঞ্জের যৌনপল্লিতেও।

চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ থেকে দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট হয়ে রবীন্দ্র সরণি। রাতে শহর যখন ঘুমিয়ে পড়ে, এ রাস্তায় তখন ‘সূর্যোদয়’ হয়। সোনাগাছির সেই ভিড় জমতে শুরু করে দুপুরের শেষ থেকেই। শুক্রবারের বসন্ত-বিকেলে দৃশ্যটা একেবারে অন্য। খাঁ খাঁ করছে সোনাগাছি। যৌনকর্মী কম, খদ্দের হাতে-গোনা।

কারণ করোনাভাইরাস।

ভাইরাসের ভয়ে একই ছবি বউবাজার, কালীঘাট, খিদিরপুর, ওয়াটগঞ্জের যৌনপল্লিতেও। যৌনকর্মীরা বলছেন, নোট বাতিলের পরও নগদের অভাবে ভিড় কমে গিয়েছিল যৌনপল্লিতে। সে বারও এমন ‘দুর্দশা’ হয়নি।

তাতে যৌনকর্মীদের পেটে টান পড়লেও, বিশেষজ্ঞরা এই প্রবণতায় আশীর্বাদই দেখছেন। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে বড় জমায়েত। অথচ, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট, অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট, মসজিদ বাড়ি লেন, রবীন্দ্র সরণি, শেঠবাগান, রামবাগান মিলিয়ে দৈনিক ৩০-৪০ হাজার খদ্দের আসেন। সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ ও বাসিন্দা মিলিয়ে ১০-১২ হাজার যৌনকর্মী। এক জায়গায় বেশি লোকজন মানেই সংক্রমণের বেশি সম্ভাবনা। পরিস্থিতি সামলাতে করমর্দন করতেও বারণ করা হচ্ছে। সেখানে যৌনপেশায় সংস্পর্শ এড়ানো সম্ভবই নয়।

তাই আতঙ্কে যৌনপল্লিমুখো হওয়া কমিয়েছেন খদ্দেররা। খদ্দের কম আসায় আনাগোনা কমেছে ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীদেরও।

বিকেলে অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিটে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়েছিলেন বারাসতের এক যৌনকর্মী। বললেন, ‘দোলের পর থেকেই লোকজন কম। আগে দিনে অন্তত তিন-চার জন খদ্দের পেয়ে যেতাম। ক’দিন ধরে দেখছি, এক-দু’জন পাওয়াই অনেক!’ সংক্রমণের ভয় নেই? পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য এক যৌনকর্মীর জবাব, ‘ভয় একটা আছে, কিন্তু কী করব! আমাদের যা কাজ, তাতে তো মাস্ক পরে থাকলে চলবে না!’

এঁরা ভ্রাম্যমাণ। দুপুরে আসেন, সন্ধের পর পরই বাড়ি ফিরে যান। দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটের এক স্থায়ী বাসিন্দার গলাতেও এক অসহায়ের সুর, ‘দেশে টাকা পাঠাতে হয়। বাচ্চার খরচ রয়েছে। কাজ হোক না হোক, ঘরভাড়া দিতে হবে। এত ভয় পেলে আমাদের চলবে না!’ সোনাগাছিতে নানা ধরনের ঘর রয়েছে। মাসিক পাঁচ-সাত হাজার টাকা থেকে রয়েছে ৬০-৭০ হাজার টাকার ভাড়ার ঘরও। এই অবস্থায় ভাড়া মেটানোর টাকা জোগাড় করাই বড় চ্যালেঞ্জ যৌনকর্মীদের সামনে।

আতান্তরে রূপান্তরকামীরাও। সোনাগাছিতে অনেক রূপান্তরকামীই যৌনপেশায় জড়িত। তাদেরই একজন বললেন, ‘আমাদের আয় এমনিতেই কম। বেশি ভাবলে কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। ফলে যতক্ষণ খদ্দের পাচ্ছি, ততক্ষণ আছি।’ আয় কমেছে দালাল হিসেবে কাজ করা কয়েক হাজার ব্যক্তিরও। এক দালালের আক্ষেপ, ‘ফোন করলেই করোনার কথা বলছে। মেসেজ আসছে। রোগের কথা জানে না, এমন কেউ নেই। সবারই তো প্রাণের ভয় আছে!’

যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সভানেত্রী বিশাখা লস্কর থাকেন শেঠবাগানে। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘মেয়েদের কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, দেখতে রাতে আমরা পরিদর্শনে বেরোই। শেঠ গলিতে ২০০-২৫০ মেয়ে থাকে। বৃহস্পতিবার রাতে দেখি হাতে গোনা চার-পাঁচ জন দাঁড়িয়ে। ভিড় কম কেন, জিজ্ঞাসা করতে ওরা বলল, কী একটা রোগ বেরিয়েছে, লোকজন আসছে না! সব পল্লিতেই এক অবস্থা।’

করোনা-সংক্রমণ ঠেকাতে কী করা উচিত, কী উচিত নয়, তা নিয়ে পোস্টার সাঁটিয়েছে প্রশাসন। তবু যৌনকর্মীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব যথেষ্ট। কয়েক দশকের লড়াইয়ের পর কন্ডোমের ব্যবহার নিশ্চিত করে এইচআইভি সংক্রমণে রাশ টেনেছিল সোনাগাছি। এ বার করোনা নিয়েও কর্মসূচি তৈরি হচ্ছে। দুর্বারের সচিব কাজল বোস বলেন, ‘সোমবার থেকেই সচেতনতা অভিযানে নাম বো আমরা।’

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password