সারা দেশে ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে রাসেলস ভাইপার। রাসেল ভাইপার সাপ চরিত্র পাল্টে যমদূত হয়ে ঢাকার কাছে চলে এসেছে। মানিকগঞ্জে চরাঞ্চলে রাসেলস ভাইপার এর আতঙ্কে দিন কাটছে মানুষের। দুর্গম চরে হিংস্র রাসেলস ভাইপারের হানা, গ্রামে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাসেলস ভাইপারের দংশনে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। অথচ প্রায় দুই যুগ আগে বাংলাদেশ থেকেই বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিলো রাসেলস ভাইপারকে। ঠিক কিভাবে আবারো বাংলাদেশে ফিরে এসেছে ভয়ংকর এই সাপ? কীভাবেই বা এই সাপ থেকে সতর্ক থাকতে হবে?
দেশের বিভিন্ন জেলার নদীকেন্দ্রিক এলাকা ও চরাঞ্চলে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসাবে ধরা দিয়েছে বিষধর সাপ রাসেল’স ভাইপার (চন্দ্রবোড়া)। কয়েক সপ্তাহে এ সাপের কামড়ে কৃষকসহ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। সাপটির কামড়ে ইতোমধ্যে পঙ্গু হয়েছেন অনেকে। অনেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। রাসেল’স ভাইপারের ভয়ে কয়েকটি এলাকায় কৃষক পাকা ধান কাটতে যাচ্ছেন না।
গত বছর ২০টি জেলায় রাসেল’স ভাইপার পাওয়া গেলেও বর্তমানে এ সাপ ছড়িয়ে পড়েছে আরও ১০টি জেলায়। এসব জেলায় মূলত নদী অববাহিকা ও নদীতীর থেকে দেড় কিলোমিটারের ভেতরে এদের পাওয়া গেলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে, সাপটি ধীরে ধীরে তার বিস্তৃতি ও প্রজনন বাড়িয়ে আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
দেশে জন্ম নেওয়া রাসেল’স ভাইপারের মধ্যে ৭৮ শতাংশই স্ত্রী প্রজাতির। এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে আগামী দিনে রাসেল’স ভাইপারের কামড়ে মানুষের মৃত্যু বেড়ে যাবে। এ সাপের কামড়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর দুই দেশ ভারত ও শ্রীলংকার চেয়েও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কারণ, দেশে অনেক এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব এ দুই দেশের চেয়ে বেশি। এখন পর্যন্ত দেশের ২৮টি জেলায় রাসেল’স ভাইপারের অবস্থান, কামড়, মৃত্যু ও হতাহতের খবর পাওয়া যায়।
জেলাগুলো হলো নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম।
ধারণা করা হয়, ২০০৯ সালে ফারাক্কার সব বাঁধ খুলে দেওয়ায় বিহারসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকার নদী অববাহিকা ধরে বাংলাদেশে রাসেল’স ভাইপার নতুন করে প্রবেশ করে। সেসময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গোদাগাড়ি (যে অংশে পদ্মা নদীর প্রবেশ) এবং বরেন্দ্র অঞ্চলে সাপটির দেখা মেলে। সাপটির কামড়ে কয়েকজন মারাও যান তখন।
রাসেল’স ভাইপার নিয়ে শুরু থেকেই গবেষণা করছেন রাজশাহীর সাপ বিশেষজ্ঞ বোরহান বিশ্বাস রোমন। তিনি বলেন, দেশে রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি দিনদিন বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত সাপটি মূলত নদী অববাহিকায় নদীর দুই তীর থেকে এক-দেড় কিলোমিটারের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। নদীর চরাচঞ্চলেও এদের অবাধ বিচরণ। এরা আগামী দিনে ধীরে ধীরে আরও ছড়িয়ে যাবে বলে মনে করি।
খাবারের খোঁজে বা প্রজননের তাগিদে প্রতিবছর যদি আধা কিলোমিটার বা এক কিলোমিটার করেও নদী অববাহিকা থেকে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে, তাহলে আগামী ১০ বছরে বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে যাবে। এই গবেষক বলেন, আমরা পদ্মাকেন্দ্রিক ৭-৮ বছরের ডেটা কালেক্ট করেছি।
দেখা যাচ্ছে, রাসেল’স ভাইপারের জুভেনাইল বেবিদের (দেশে জন্ম নেওয়া এবং বছরের বাচ্চা বা গত বছরের বাচ্চা) মধ্যে ৭৮ ভাগই স্ত্রী প্রজাতির। এতে বোঝা যায়, এ সাপের প্রজনন দেশে আরও বাড়বে। এরা পদ্মার বিভিন্ন চরে কাশবন, ছায়ায় থাকত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ কাশবন কেটে কৃষিজমির আওতায় আনা হয়েছে।
এ কারণেও সাপগুলো ধানখেত, কৃষিজমিতে বাসা বেঁধেছে, খাবার খোঁজ করছে। বিশেষ করে ধান কাটতে গিয়ে রাসেল’স ভাইপারের কামড়ের শিকার হচ্ছেন কৃষক।
রাসেল’স ভাইপারের কামড়ে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, রাসেল’স ভাইপারের কামড়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। স্পষ্ট বলতে চাই, রাসেল’স ভাইপারে কামড়ানোর পর ওঝার কাছে গিয়ে কালক্ষেপণ করা যাবে না। কামড়ের পর যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতালে যেতে হবে।
যেখানে অ্যান্টিভেনম দেওয়ার সুবিধা আছে, সেখানেই যেতে হবে। বিষের প্রভাব শরীরে দেখা দেওয়ার পর যত দ্রুত অ্যান্টিভেনম দেওয়া সম্ভব হবে, মৃত্যুর আশঙ্কা তত কমবে। যত দেরি করবে, তত জটিলতা বাড়বে। বাড়বে মৃত্যুও।
বোরহান বিশ্বাস রোমন বলেন, অবজারভেশনে দেখেছি, রাসেল’স ভাইপারের কামড়ে অ্যান্টিভেনম নিয়ে বিষ নিষ্ক্রিয় করে বাড়ি ফেরার পরও ৫০ ভাগ মানুষ নানা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। তাদের মধ্যে ১৭ ভাগ ১-১২ মাসের মধ্যে মারা যান। রাসেল’স ভাইপারের কামড়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তাতেই এমনটা ঘটে। অনেকের কিডনি ফেল করে। ডায়ালাইসিস করতে হয়।
বাড়ি ফেরার সাতদিন থেকে দুই মাসের মধ্যে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। অনেকের চোখের পাতা অর্ধেক সব সময় পড়ে থাকে। অনেকের হাত-পা কাটতে হয়। অনেকে হারান যৌনক্ষমতা। রাসেল’স ভাইপারের কামড়ে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় এখনো ব্যবহার করা হয় ভারতীয় অ্যান্টিভেনম। এটি সব সময় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না। তবে দেশীয় রাসেল’স ভাইপারের বিষ থেকে তৈরি অ্যান্টিভেনমেই প্রকৃত সমাধান আছে বলে মনে করা হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে দেশীয় রাসেল’স ভাইপারের বিষ থেকে ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরির কাজ চলমান আছে। এ কাজের অগ্রগতির বিষয়ে ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, রাসেল’স ভাইপারের জন্য দুটি ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি করার কথা রয়েছে।
এর মধ্যে মুরগির ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি করতে পেরেছি। এতে ‘অ্যান্টিবডি’ আছে। কিন্তু এটির পিউরিফিকেশন প্রয়োজন। ছাগলের অ্যান্টিবডির জন্য রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু অ্যান্টিবডি এখনো আলাদা করা হয়নি। আরেকটু সময় লাগবে। আশা করা যায়, ৬-৯ মাসের মধ্যে অ্যান্টিবডির ফলাফল পাওয়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন