কোকাকোলা-পেপসি বয়কটে বিক্রি কমেছে ৬০শতাংশ

কোকাকোলা-পেপসি বয়কটে বিক্রি কমেছে ৬০শতাংশ

বয়কটে কোকাকোলা-পেপসি বিক্রি কমেছে ৬০শতাংশ। ফিলিস্তিনের গাজায় দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা শুরুর পর থেকে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন কোম্পানি বয়কটের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য মুসলিম দেশের নাগরিকরাও এতে একাত্মতা প্রকাশ করেন। বয়কটের ডাক দেওয়া হয় কোকাকোলা-পেপসিসহ বিভিন্ন বিদেশি পণ্য। মাঝে বাংলাদেশে বয়কটের আন্দোলন কিছুটা স্থবির গেলেও সম্প্রতি কোকাকোলা বাংলাদেশের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর বিষয়টি আবার সামনে আসে।

অনলাইন-অফলাইনে সরব হয়ে ওঠেন ইসরায়েল-বিরোধীরা। এতে আগের তুলনায় তীব্র হয়েছে কোকাকোলা-পেপসির বয়কট আন্দোলন। অনেকে বলছেন, বয়কটের আগুন নেভাতে তৈরি করা বিজ্ঞাপনটিই উল্টো বয়কটের আন্দোলনে ঘি ঢেলেছে। ফলে দেশের খুচরা দোকানগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে কোমল পানীয় কোকাকোলা, পেপসি ও সাধারণ পানীয় কিনলের বিক্রি। এতে পাড়া-মহল্লার খুচরা দোকানিরা পড়েছেন বিপাকে।

সম্প্রতি রাজধানীর বেশ কয়েকটি আবাসিক, ব্যবসায়িক, বাণিজ্যিক এবং পাড়া-মহল্লার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও খুচরা দোকানে ঘুরে কোকাকোলা, পেপসি, স্প্রাইট, কিনলের বিক্রি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। এর মধ্যে নিউমার্কেট এলাকার বেশিরভাগ দোকানি জানান, গত কয়েক মাস ধরে কোকাকোলা ও পেপসির বাজারে মন্দা চলছে। অধিকাংশ গ্রাহক এই দুটি পানীয়র পরিবর্তে দেশীয় কোম্পানির তৈরি অন্য পানীয় চাইছেন।

তারা মোজো, ক্লেমন, আরসি, জিরা পানি পান করছেন। আর দেশীয় কোলা বা পানীয় না পেলে কোকাকোলা বা পেপসি কেনা থেকেও বিরত থাকছেন। নিউমার্কেট এলাকার এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বিক্রেতা বলেন, কোক-পেপসি আগের চেয়ে কম চলছে। মানুষ কোমল পানীয় কেনার সময় জানতে চাইছে এই দুটো বাদে অন্য কিছু আছে কি না। মূলত ইসরায়েলি কোম্পানির তৈরি পণ্য ভেবে এই দুটি পানীয় কম কিনতে চাইছে। তবে স্প্রাইট বা ফ্যান্টায় বয়কটের বিষয়টি তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। আমরাও ক্রেতার চাহিদার কথা বিবেচনা করে যথাসম্ভব দেশীয় পণ্য রাখার চেষ্টা করছি। তবে চাহিদা বেশি থাকায় অনেক সময় কোম্পানির কাছে চাইলেও তারা দিতে পারছে না।

নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে আরেক দোকানি বলেন, ফিলিস্তিনে ইসরাইলের হামলা শুরুর পর থেকেই কোক ও পেপসির বিক্রি কমতে শুরু করে। পরে এগুলো বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। মাঝে বয়কটের বিষয়টি অনেকটা থেমে গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে আবার জোরালো হয়েছে। কয়েক মাস ধরেই কোকের বিক্রি একেবারে তলানিতে।

গত কয়েকদিনে আমার দোকানে মাত্র দুই-তিনটি কোক বিক্রি হয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের আর্থিক ক্ষতি হবে। কারণ মানুষ অন্য কোম্পানির কোমল পানীয় না রাখলে দোকান থেকেই চলে যাচ্ছে। আবার ফেসবুকেও এখন বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সেজন্য ঈদের সময়ে ব্যবসা ভালো না হলে ছোট ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে।

আগারগাঁওয়ের একটি দোকানের বিক্রেতা বলেন, পেপসির বিক্রি একেবারেই বন্ধ। কোকাকোলা দিনে ৪-৫টি বিক্রি হয়। আগে দৈনিক ৪-৫ কেইস কোকাকোলা আমার দোকানে বিক্রি হয়েছে। এখন বয়কটের প্রভাবে বিক্রি নেই। একচেটিয়াভাবে মোজো চলছে। মিরিন্ডাও চলছে মোটামুটি। আগে ঈদের সময় কোকাকোলা-পেসসির ব্যাপক চাহিদা থাকত। এবার চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন।

কোকাকোলা বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৮২ সালে আব্দুল মোনেম লিমিটেডের কোমল পানীয় উৎপাদনকারী ইউনিট কোকাকোলার ফ্রাঞ্চাইজ বোতলজাতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। এখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশের বাজারে কোকাকোলার বোতলজাত, প্যাকেজিং, বিক্রি এবং বিতরণের দায়িত্ব পালন করছে।

তবে বর্তমানে চলা বয়কটের অবস্থা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কখনো দেখতে হয়নি কোকাকোলা বাংলাদেশকে। চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এবং গ্রাহক টানতে কোকাকোলা বাংলাদেশ সম্প্রতি নতুন একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করে। যা গ্রাহকের কাছে ইতিবাচক হওয়ার বদলে উল্টো বুমেরাং হয়েছে। বিজ্ঞাপনটি বয়কট আন্দোলনকে আরও বেশি জোরদার করেছে। শহরাঞ্চল থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও বয়কটের আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।

একইসঙ্গে দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যে ঝুঁকছেন তারা। দেশীয় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের তৈরি কোমল পানীয় মোজো ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বাজিমাত করেছে। তাদের বিক্রি করা মোজোর প্রতিটি বোতল থেকে ১ টাকা করে যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের সহায়তায়।

এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে মোজো সাপোর্ট প্যালেস্টাইন র‌্যালিও করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সবমিলিয়ে ফিলিস্তিনের গাজাবাসীকে সহায়তার সুবাদে দেশের কোমল পানীয়ের বাজারে বড় স্থান দখল করে নিয়েছে মোজো। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দৈনিক ডোনেশন উঠছে ৩২ হাজার ৯৮৭ টাকা। আর এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিন দূতাবাস, কাতার, তুরস্কসহ ফিলিস্তিনদের জন্য ত্রাণ সহায়তা বিতরণে দক্ষ কিছু সংস্থার মাধ্যমে ২০ কোটি ২ লাখ ৪১ হাজার ২৯৯ টাকা সহায়তার জন্য পৌঁছানো হয়েছে।

গত কয়েকদিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আগের চেয়ে জোরালো হয়েছে কোকাকোলা ও পেপসি বয়কটের ঘোষণা। ‘যে দোকানেই থাকবে কোক, সেই দোকানই বয়কট হোক’, ‘কোকাকোলা বিদায় দিন, মুসলমানের পক্ষ নিন’ সহ নানা স্লোগানে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ছবিতে দেখা গেছে, অনেক দোকানি ঘোষণা দিয়ে দোকানে কোকাকোলা কোম্পানির সব কোমল পানীয় এবং পানি রাখা বন্ধ করেছেন। এ ছাড়া বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় বিভিন্ন ইসলামিক স্কলাররাও কোকাকোলা কোম্পানির কোমল পানীয় বর্জনের জন্য তাদের ভক্ত-সমর্থকদের আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে কোকাকোলা-পেপসি বয়কটের বিষয়টি কোম্পানির ভবিষ্যতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে কোনো কোম্পানি বা তার পণ্য বয়কটের বিষয়গুলো সামনে আসে। তবে কোকাকোলা বর্জনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি মানুষের ইমোশন কাজ করছে। কারণ মার্কেটিংয়ের ভাষায় আমরা বলি, মানুষ যুক্তি দিয়ে সবকিছু দেখতে অভ্যস্ত নয়।

সেদিক থেকে মানুষ অনেক সময় ইমোশনালি বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করে। কোকাকোলার ক্ষেত্রেও বিষয়টি তাই হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ শুধু যে কোকাকোলা বর্জন করেছে বিষয়টি এমন নয়। এর আগে ভারতীয় পণ্য বয়কটের বিষয়টিও সামনে এসেছিল। এগুলো ইমোশন বেজড। ক্রেতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যতক্ষণ বিষয়গুলো দেখা হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত এমন অবস্থার উন্নতি হবে না।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password