অন্তর্বর্তীতে স্বৈরাচারের প্রভাব

অন্তর্বর্তীতে স্বৈরাচারের প্রভাব

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে শুরু হয় সংস্কার। এ সংস্কার করতে গিয়ে বারবার বলা হচ্ছে স্বৈরাচারের দোসররা বিভিন্ন কায়দায় প্রশাসনে প্রভাববলয় বাড়াচ্ছেন, পদোন্নতি নিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবরা সক্রিয় হয়েছেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে।

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি কারও নাম না নিলেও কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে নাম বলেই প্রতিবাদ করছেন। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, ২০২৪ সালের বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকা প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও কুশীলবদের নাম উচ্চারণ করে প্রতিবাদ করেছেন। দলগুলো বলছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী আলী ইমাম মজুমদার এবং তার ব্যক্তিগত সহকারী আহসান কিবরিয়ার নির্দেশনায় আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের পদোন্নতি হচ্ছে। যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে।

কী বলছে রাজনৈতিক দলগুলো?

ওয়ান ইলাভেন নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি স্পষ্ট করে বলেছেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর সংখ্যালঘু নির্যাতন ও দখল নিয়ে বিএনপিকে লক্ষ্যবস্তু করে প্রচার চালানো হচ্ছে। আবারও এক-এগারোর মতো বিএনপিকে লক্ষ্য করে বিরাজনৈতিকীকরণের চেষ্টা থেকে এ কাজগুলো করা হচ্ছে। ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত এক-এগারো সরকারের প্রসঙ্গ তুলে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা তো ভুলে যাইনি এক-এগারোর সময় কারা চেষ্টা করেছিল বিরাজনৈতিকীকরণের।

এমনকি ওই সময় আমাদের দলকে পর্যন্ত পুরোপুরি বাতিল, নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টাও হয়েছিল। এ কথাগুলো তো আমরা ভুলতে পারি না। আমার গণতন্ত্রের জন্য, আমার রাজনীতির জন্য, আমার দেশের কল্যাণের জন্য এ কথাগুলো আমার মনে রাখতে হবে। ’ ‘যাদের কোনো দিন দেখা যায়নি, তারা সামনে চলে আসছেন। হঠাৎ করে ওই ব্যক্তিগুলো মিডিয়ায় সামনের পেজে চলে আসছেন,— বলছিলেন বিএনপি মহাসচিব।

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এখনো স্বৈরাচারের দোসররা লুকিয়ে আছে। স্বৈরাচারের দোসরদের দ্রুত খুঁজে বের করে অপসারণ করার পাশাপাশি বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। অন্তবর্তী সরকারের উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সম্প্রতি বলেছেন, আপনারা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) ওয়ান ইলেভেনের সুবিধাভোগীদের চতুর্দিকে বসিয়েছেন। শেখ হাসিনার সুবিধাভোগীদের সঙ্গে নিয়ে সরকার চালাচ্ছেন। সেজন্যই আজ এই অবস্থা। সরকারের বয়স এখন দুই মাস হয়ে যাচ্ছে।

এখনও কি আপনাদের ঘুম ভাঙেনি? আপনাদের চারদিক থেকে ওয়ান ইলেভেন এবং স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা ঘিরে ধরেছে। এদের থেকে বের হয়ে না এলে ওরা আপনাদেরও গিলে খাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কাজেই দয়া করে ঘুম থেকে উঠুন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, ছাত্র-জনতা আপনাদের পাশে আছে।

আপনারা দয়া করে সচেতন হোন। বিএনপির দীর্ঘদিনের জোট শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান যুগান্তরকে বলেন, ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবরা একবার ব্যর্থ হয়েছিল। এবার সে প্রজেক্ট নিয়ে আবারও কাজ করছেন আলী ইমাম মজুমদার। যারা নিয়োগ পাচ্ছেন তার অধিকাংশই আওয়ামী লীগের দোসর। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে শেষ করার জন্যই কাজ করছেন তারা।

তিনি প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ফ্যাসিবাদদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ছাত্র-জনতার সঙ্গে আমরা সবাই বিজয় অর্জন করেছি। তাকে এ পদ থেকে না সরালে বিপ্লবের সুফল ভোগ করতে পারবে না জনগণ। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান যুগান্তরকে বলেন, আলী ইমাম মজুমদারের বিরুদ্ধে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই বলছেন। সমন্বয়ক সার্জিস যে বিষয়টি ফেসবুকে বলেছেন তাতে করে দ্রুত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উচিত তার পদত্যাগের জন্য রাস্তায় নামা।

ড. ইউনূসকে বিতর্কিত করতেই তার পাশে থেকে এক-এগারোর কুশীলবরা কাজ করছে যা উচিত নয়। তাই দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা এবং এসময় এ পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ বলেছেন, আমরা জানতে পেরেছি ৫৬ জন ডিসির মধ্যে ৪৯ ডিসিই আলী ইমাম মজুমদারের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগিরাই পাদায়ন পাচ্ছে। এবং তার মাধ্যমে আবারও আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে।

তারা যে কাজ করছে তা বিপ্লব বিরোধী। সারজিস আলম যা বলেছিলেন হাসিনা পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম তার ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, আহসান কিবরিয়া শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক মেয়াদে পরিচালক (২০১৫-২০২০), দুই মেয়াদে মহাপরিচালক (২০২০-২০২৪) ৷

ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের দিনও আহসান কিবরিয়া শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মহাপরিচালক ছিলেন ৷ এই আহসান কিবরিয়াকে বর্তমানে রানিং ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) বানিয়েছেন আলী ইমাম মজুমদার ৷ ইমাম মজুমদার যখন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন (২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল) তখন আহসান কিবরিয়া ছিলেন তার একান্ত সচিব ৷ আলী ইমাম মজুমদার ১৯৯৬ মেয়াদে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিলেট ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ছিলেন।

২০০৭-০৮ কেয়ারটেকার সরকারের আমলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এবং পরবর্তীতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। দেশের রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ রয়েছে বর্তমানে সময়ে আলী ইমামের নির্দেশনায় বিভিন্ন দপ্তরে পদায়ন হচ্ছে। পুনর্বাসন হচ্ছে স্বৈরাচার হাসিনার দল আওয়ামী লীগ। জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ ইস্যুতে সারজিস আলম বলেন, ডিসি নিয়োগে যদি আওয়ামী দোসররা স্থান পায় তবে উপরের এই মানুষগুলো (আলী ইমাম মজুমদার ও তার পিএস আহসান কিবরিয়া) কী করছিল ?

তাদেরকে প্রশ্ন করা হয় না কেন? তাহলে তো তারা- হয় ব্যর্থ না হয় তাদের কাজ তারা করে না ৷ গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খানকে উদ্দেশ্য করে সারজিস বলেন, আরও ১৬ বছর আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করা একজনকে কেন এখন জনপ্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়া হলো সেই প্রশ্ন রাশেদ ভাই করতে পারেন না৷ আহসান কিবরিয়া কীভাবে অভ্যুত্থানের পর তার পিএস সেই প্রশ্ন তারা করতে পারেন না৷

সারজিস বলেন, ২ মাসের মধ্যে ৩টা প্রমোশন পেয়ে ওই ফিল্ডে কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়া কীভাবে একজন সিনিয়র সহকারী সচিব অতিরিক্ত সচিব বনে গেলেন? কীভাবে এখনও সচিবালয়ে টাকা লেনদেন হয়। রাজনৈতিক নেতা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের এসব অভিযোগের বিষয়ে আলী ইমাম মজুমদার বা আহসান কিবরিয়া কেউ এখনো কোনো কথা বলেননি।

সূত্রঃ যুগান্তর

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password