একটা চমৎকার বই পড়লাম, ম্যলকম গ্ল্যাডওয়েলের। ‘আউটলায়ার্স’ বা বাংলায় বললে দাঁড়ায়, ‘বৃত্তের বাইরে’–নামের বইটিতে লেখক পৃথিবীর তাবত পুরোধাদের উদাহরণ টেনেছেন। অর্থ-খ্যাতি-মেধা—যে বলেই হোক না কেন যারাই সফলকাম তাদের এক্কেবারে একজনও নেই যে কিনা ‘ভাগ্যবলে কোটিপতি’! তাহলে তাদের এমন কী ছিল যেটা অন্যদের নেই? বিল গেটসের কথাই ধরি। যখন ক্লাস এইটের ছাত্র তখন স্কুলের কম্পিউটার ক্লাব থেকে তার প্রোগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি।
গেটসের ভাষ্যমতে, এমন একটা সপ্তাহও যায় নি যখন অন্তত ৩০ ঘন্টা ঐ কম্পিউটার রুমে তিনি কাটান নি! মানে প্রত্যেকদিন কমসে কম ৪ ঘন্টা! আর সেসময়টাতে কম্পিউটারে কাজ হতো সময় ধরে, ঘন্টা হিসেবে টাইম-শেয়ারিং-টার্মিনাল ভাড়া পাওয়া যেত। এর মধ্যে আইএসআই (ইনফরমেশন সায়েন্স ইনকর্পোরোটেড) নামক এক প্রতিষ্ঠানে একটা সফটওয়্যার বানিয়ে দেয়ার বিনিময়ে গেটস পেলেন সেখানকার কম্পিউটারে ফ্রি কাজ করার সুযোগ।
ঐ বছর, ১৯৭১ সালে, সাত মাসে ১,৫৭৫ ঘন্টা তিনি ব্যয় করেন কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের পেছনে। মানে হলো সপ্তাহে সাত দিন—প্রতিদিন ন্যূনতম আট ঘন্টা করে! হার্ভার্ডের স্নাতক পড়া মাঝপথে যখন তিনি ছেড়ে দিলেন তখন ইতোমধ্যে তিনি নিজের একটা সফটওয়্যার কোম্পানির মালিক। পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার মধ্যে কি তার পাগলামি ছিল? নাকি ছিল সাত বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম (১০,০০০ বা তারও বেশি ঘন্টার অনুশীলন!) করে পাওয়া ‘সৌভাগ্য’? প্রযুক্তি জগতের আরেক পুরোধা—সান মাইক্রোসিস্টেমসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল জয়ের ‘সৌভাগ্য’ও এসেছে সাধনার ছদ্মবেশে। মিশিগান ভার্সিটির এ্যান আরবার ক্যাম্পাসের কম্পিউটার সেন্টারে দিনে তার ব্যয় হতো আট থেকে দশ ঘন্টা! জয়ের ভাষায়, “..সারারাত জেগে কাজ করতাম.. প্রতি সপ্তাহে ক্লাসের চাইতে বেশি সময় দিতাম প্রোগ্রামিংয়ের পেছনে.. মাঝেসাঝে ঘুমিয়ে পড়তাম কি-বোর্ডের উপর...!”
তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে ছাড়তে ঠিক কত ঘন্টা তার ব্যয় হয়েছে প্রোগ্রামিংয়ের পেছনে? ১০,০০০ ঘন্টা বা কিছু বেশি! আবার ধরুন, গান-বাজনা তো মেধার ব্যাপার, রক্তে না থাকলে কী আর গলায় সুর বাজে? এখন বিটলসের কথাই ধরি। খ্যাতিতে উঠবার আগে যখন বিটলস কেবলই একটা হাই-স্কুল ব্যান্ড সেসময় তাদের ডাক আসে জার্মানির হামবার্গে। একটা ক্লাবে গাইতে হতো তাদের। কতক্ষণ? দিনে আট ঘন্টা! ১৯৬০ থেকে ১৯৬২-র মধ্যে পাঁচবার জার্মানি যাওয়া-আসা হয়।
প্রথমবার তারা গেয়েছিলেন ১০৬ টি শো-তে, প্রতিটিতে ৫/৬ ঘন্টা করে। দ্বিতীয় ট্যুরে ৯২ বার তাদের গাইতে হয়। আর তৃতীয় ট্যুরে ৪৮ বারে মোট ১৭২ ঘন্টা! ১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মতন ‘জনপ্রিয়’ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ১২০০ বার তাদের স্টেজে পারফর্ম করা হয়ে গিয়েছিল! খুব কম ব্যান্ডই আছে যারা পুরো জীবনে হয়তো ১২০০ বার স্টেজ-পারফর্মমেন্স করার সুযোগ পায়। এখন প্রশ্ন হলো পরিপার্শ্বের কি কোনো ভূমিকা নেই? অবশ্যই আছে। অর্থবান ঘরের সন্তান না হলে বিল গেটস হয়তো লেকসাইড স্কুলে যেতে পারতেন না।
আর ১৯৬৮ সালে ঐ স্কুলের মায়েদের মিলে ৩০০০ ডলার দিয়ে কেনা কম্পিউটারে কাজ করার সুযোগও তার হতো না। কিন্তু এই সুযোগটা ঐ স্কুলের আর সব ছাত্রদের জন্যেও ছিল; বিল গেটস তাহলে সমসাময়িক সব্বার চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেলেন কীভাবে? আবার বিল জয়ের কথা যদি বলতে হয়, তার ক্ষুরধার মেধাকে কী অস্বীকার করা যাবে? পরীক্ষার খাতায় তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন তা ছিল তার প্রফেসরদের জ্ঞানের অতীত! কাগজকলমে যে প্রোগ্রাম একদল লোকের বসে করতে হতো তা তিনি মুখেমুখে করে ফেলতেন।
কিন্তু এতসবের পরও কেন তিনি মুখ গুঁজে পড়েছিলেন কম্পিউটারের সামনে? অথবা বিটলস যদি কেবল ‘জিনগত’ সুরের বলেই খ্যাতিমান হতো তবে রাতের পর রাত গান গেয়ে যাওয়া কেন? হ্যাঁ, প্রত্যেকের কাছেই সুযোগ এসেছে, কিন্তু সেটাকে কাজে তারা লাগাতে পেরেছেন অক্লান্ত পরিশ্রমের জোরেই। বিটলসের জন লেনন যেমন বললেন, “..লিভারপুলে এক ঘন্টা গাইতে হলে আমরা কেবল আমাদের সেরা গানগুলোই বার বার গাইতাম।
কিন্তু হামবার্গে আট ঘন্টার শো করতে গিয়ে দেখলাম গান ফুরিয়ে আসছে.. অতএব ভীষণ চেষ্টা করতে হতো নতুন নতুন সুর খুঁজতে.. এই করতে গিয়েই গানের পেছনে আমাদের রক্ত-ঘাম-আত্মা মিশে গেল-তৈরি হলো নতুন নতুন সুর- নতুন গায়কী-” এখন প্রশ্ন হলো, আমরা তাহলে সফল হতে পারি না কেন? মূলত দুইটা কারণ: প্রথমত, আমরা ভাবি সফল হতে গেলে ‘জন্মভাগ্য’ আবশ্যক।
কখনও এটাতে বোঝায় ‘পারিপার্শ্বিক সুযোগ-সুবিধা আমার নেই’, কখনও ‘অমুকের মতন আমার আমার ব্রেইন ভালো না’ অথবা ‘আমার কোনো মেধা নেই। কিন্তু যেমনটা লেখক দেখালেন, পরিবেশের অজুহাত কেবলই বাক্ওয়াস। আর, উল্টোদিকে, ‘ন্যাচারাল ট্যালেন্ট’ও যে খুব আহামরি সাফল্যের জন্ম দেয় তা-ও না। বরং পরীক্ষা করে দেখা গেল খুব সাধারণ মানের মানুষেরাই অনেক বেশি সফল; কারণ অতিরিক্ত-আত্মবিশ্বাস নেই বলে অনুশীলনের বেলায় তারা কোনো ফাঁকিবাজি করেন না।
আর দ্বিতীয়ত, আমরা মুখে যত বড় বড় কথাই বলি না কেন বাস্তবে ততটা কাজ করি না। হ্যা, পরিশ্রম করি ঠিকই; কিন্তু ঠিক যতটা ‘আত্মপ্রসাদ’ লাভ করি- ভাবি ‘প্রচুর কাজ করে ফেলেছি’—ততটা আসলে যথেষ্ট না। এই ব্যপারটা মানতে কষ্ট হলেও আমার নিজের বেলায়ও দেখেছি- খুব সত্যি।
গ্র্যাজুয়েশনের পাশাপাশি একটা চাকরি করতে গিয়ে গ্রেড ‘এ’ থেকে ‘এ-মাইনাস’ হলেও দেখি গায়ে লাগছে না! মনে মনে অজুহাত দাঁড় করাই: চাকরি করে রাত ১০টায় বাসায় এসে এর থেকে বেশি কী পড়ালেখা করা যায়! কিন্তু তা তো না। তাহলে ঠিক কতটা হলে যথেষ্ট? এ ব্যাপারে এক শিক্ষক আমাকে বলছিলেন তার জীবনের কথা। বিবিএ আর কম্পিউটার সায়েন্স একসাথে পড়েছেন তিনি, আমেরিকার খরচ চালাতে গিয়ে সপ্তাহে ৬০ ঘন্টা তিনটা পার্ট-টাইম চাকরি করেছেন! এরপরও জিপিএ ৪.০ রেখেছেন।
স্যারের কথা হলো, “খুব সাধারণ মানের মেধা নিয়েও আমি যে রেজাল্ট করেছি অনেক প্রতিভাবান তা পারে নি; কারণ মেধায় পাল্লা দিতে না পারি, অন্য কেউ যেন আমার থেকে বেশি পরিশ্রম না করতে পারে—এই জেদ আমার ছিল”। অতএব, পরিশ্রম করতে হবে। ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের মতে ১০,০০০ ঘন্টা- নাওয়া/ খাওয়া ভুলে, ঘোর লাগা স্বপ্নাহতের মতন, উদ্ভ্রান্তের মতন-তবেই সাফল্য অর্জিত হবে। যে চূড়াটায় উঠতে ইচ্ছে হয় তা তো সাধ্যের বাইরে নয়, কঠিন হোক অসম্ভব তো নয়।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন