এক মৃত নগরীর কথা

এক মৃত নগরীর কথা

মৃত নগরীর পথ, শুনসান চারপাশ। এই নগরীর প্রতিটি ইটে যেন জড়িয়ে রয়েছে এক অব্যক্ত ইতিহাস। দাঁড়িয়ে থাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন আর অবকাঠামো গুলো জানান দিচ্ছে এই নগরীর হারানো জৌলুসের কথা। কেমন যেন এক মায়াবী রহস্যের জালে জড়িয়ে আছে এই মৃত নগরী।

পথের দু'পাশের ভবন আর অবকাঠামো গুলোর দিকে তাকালে ভাবতে বাধ্য করে, প্রায় ৪৫০ বছর আগে এই মৃত নগরী কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সমৃদ্ধ ছিলো। একেকটি কাহিনী যেন জড়িয়ে আছে ধ্বংসস্তুপের প্রতিটি ইটে,তবুও যেন এই ধ্বংসস্তুপের আকর্ষণের কোন প্রকার কমতি নেই। ভবন গুলোর দিকে তাকালেই মনে হবে যেন ঈশা খাঁর আমলে চলে এসেছি।আর এই মৃত নগরীর নাম হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী ‘পানাম নগর’।

ঈশা খাঁ,তিনি ছিলেন বার ভূঁইয়াদের একজন এবং বাংলার সুবেদার। এক সময় বাংলার রাজধানী ছিলো সোনারগাঁ।এই সোনারগাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো নগর, ব্যাবসা-বাণিজ্য,বন্দর আরও অনেক কিছু। ব্রহ্মপুত্র,ধলেশ্বরী, মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা এই চারটি নদী দ্বারা বেষ্টিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ।

এমন ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই সোনারগাঁ ছিলো ব্যাবসা -বাণিজ্যের জন্য উপযুক্ত স্থান। আর তাই ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ এর আমলে বাংলার রাজধানী হিসেবে নামকরণ করা হয় 'সুবর্ণ গ্রাম। যা পরবর্তী সময়ে সোনারগাঁও হিসেবে পরিচিত। চীন, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয় দ্বীপপুঞ্জের সাথে এর সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে সোনারগাঁকে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী হিসেবে বর্ণনা ইবনে বতুতা (১৩৪৬)করেন।

বাংলার ‘সুবর্ণ গ্রাম’ অর্থাৎ ‘সোনার গাঁ'-কে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে গড়ে বণিক -ব্যাবসায়ীদের স্হান।যার ফলে অন্যান্য এলাকা থেকে বিভিন্ন বণিক -ব্যবসায়ীদের সবসময় আনাগোনা লেগেই থাকতো। সেই সময় উঁচু শ্রেণীর লোকজন এবং ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনেই তাদের ব্যবসায়ীরা সুবিধার্থে সুবর্ণ গ্রামে গড়ে উঠে কিছু নগরী। এর মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগর হলো “পানাম নগর “।

ইতিহাসবিদ জেমস টেলর পানাম নগর সম্পর্কে বলেছেন – “আড়ং এর তাঁতখানা সোনারগাঁ পানাম নামক স্হানে ছিলো এবং মসলিন শিল্প কেনাবেচার এক প্রসিদ্ধ বাজার ছিলো পানাম নগরে”। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে ধনী হিন্দু বণিকদের প্রভাবে এই পানাম নগরের প্রসার ঘটে। এই এলাকায় একসময় প্রসিদ্ধ ছিলো বিখ্যাত মসলিন কাপড় ও নীল ব্যবসার জন্য। বর্তমানে আমরা যে পানাম নগর দেখতে পাই, সেখানে ৬০০ মিটার দীর্ঘ এবং ৫ মিটার প্রস্থ একটি মাত্র পাকা রাস্তা রয়েছে।

এই রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে সব মিলিয়ে ৫২টি ভবন। প্রতিটি ভবন একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত। প্রত্যেকটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ইউরোপীয় ও মোঘল স্থাপত্য মিশ্রণে। ভবনগুলোতে রয়েছে স্থানীয় নির্মাণ শিল্পের নান্দনিক ছোঁয়া এবং দেয়ালগুলো বেশ প্রশস্ত।দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন আকার আকৃতির ইট আর সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু কিছু দেয়ালের অলংকরণ দেখার মতো।

অলংকরণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের রঙিন কাঁচ,নকশা,পাথর,কড়ি,চিনামাটি টেরাকোটা। বর্তমানে অধিকাংশ মেঝে ধ্বংস হয়ে গেলেও এখনো কয়েকটি টিকে আছে, বিশেষ করে যেভবন গুলোতে আনসার বাহিনীদের অবস্থান।কিছু কিছু মেঝে আছে সাদা -কালো মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি। তবে বেশিরভাগ মেঝেগুলোতে রয়েছে লাল-সাদা-কালো রঙের মোজাইক করা।

অপরিকল্পিত নগরায়ন এর কারণে আধুনিক যে ঢাকা শহর আমার দেখি সেখানে প্রত্যেক বাসিন্দা প্রতিনিয়ত শঙ্কায় থাকে। যে কোন বড় ধরনের দুযোর্গ এলে বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই। বাড়ির আশে পাশে ফাঁকা জায়গা বা উঠান এখন এসবই কল্পনা। ভাবতে অবাক লাগে, ৪৫০ বছর আগে মানুষের কাছে পপরিকল্পিত নগরায়নের গুরুত্ব থাকলেও আধুনিক সময়ে এসে আমরা তা বিন্দু পরিমাণ উপলব্ধি করতে পারছিনা বা চেষ্টা করছিনা। এই নগরের প্রতিটি ভবনের সাথে রয়েছে ফাঁকা জায়গা। কোন বাড়ির সামনে, কোন বাড়ির পিছনে আবার কোন বাড়ির মাঝখানে রয়েছে পানির কূপ,বাধানো পুকুর ঘাট ও নজর কারা উঠান।

পানাম নগর এলাকার চারপাশে ঘিরে রয়েছে গভীর খাল, যা নগরের প্রতিরক্ষার জন্য তৈরি ধারণা করা হয়।এখানে রয়েছে বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনা যেমন মন্দির,মঠ, প্যাগোডা।এই জন্যই পানাম নগরকে পরিকল্পিত নগর বলা যায়। বর্তমানে পানাম নগরের ভবনগুলোর অবস্থা খুবই দুর্বল। স্থানীয়দের মতে এর আগে পানাম নগরের ভবনগুলোর ছাদ ধ্বসে দুর্ঘটনা হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে পানামনগর সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কখনোই কার্যকর হয়নি।২০০৬ সালে বিশ্বের ১০০ টি ধ্বংস প্রাপ্ত নগরীর তালিকায় পানাম নগরের নাম করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দপ্তর পানাম নগর সংস্কারের জন্য উদ্বেগ নেয়।

পরবর্তীতে ২০০৯ সালে স্থানীয় প্রশাসন পানাম নগর কে সম্পূর্ণ দখলমুক্ত করার প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করে।সংস্কারের নামে যেনতেন ভাবে নষ্ট করা হচ্ছিল পানাম নগরের প্রত্নতাত্ত্বিক সৌন্দর্য। এতে বিশেষজ্ঞরা বাধা দিলে স্থগিত করা হয় সংস্কারের কাজ। বর্তমানে পানাম নগরে আনসার ক্যাম্প থাকলেও ব্যবস্থাপনার অভাব। শত শত বছর ধরে অনাদরে পড়ে থাকা একসময়ের জৌলস পূর্ণ পানাম নগর যেন জীবিত থেকেও মৃত।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password