শীতলক্ষ্যার তীরে মোঘল আমলের হাজীগঞ্জ দুর্গ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী

শীতলক্ষ্যার তীরে মোঘল আমলের হাজীগঞ্জ দুর্গ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী

"কার্য হেতু যাইতে পন্থে বিধির ঘটন, হার্মাদের নৌকা সংগে হৈল দর্শন।"

মহাকবি আলাওল মগ জলদস্যুদের হামলায় পিতাকে হারিয়ে এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। নদীপথে চট্টগ্রাম থেকে আরাকান যাত্রাকালে মগ জলদস্যুদের আক্রমণে মহাকবি আলাওল তার পিতাকে হারান। কবি নিজেও জলদস্যুদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এই ছিল বাংলার নদীপথের নিত্তনৈমিত্তিক চিত্র। আরাকানি মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুরা সন্দ্বীপ দখল করে নদীমাতৃক বাংলায় লুটতরাজ আর দস্যুতার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।

বাংলার মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। মগ আর হার্মাদ জলদস্যুরা হামলা করত মূলত নদীপথে। সমগ্র বাংলা অঞ্চলটি নদী দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় সহজেই বাংলায় লুটতরাজ চালাতে পারত তারা। বর্ষাকাল তাদের ছিল আঘাত করার মূল সময়। গভীর রাতে নদী তীরের ঘুমন্ত গ্রামবাসীর উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে লুট করত সমস্ত কিছু। গ্রামে ধরিয়ে দিত লেলিহান আগুন।

ছারখার হয়ে যেত সমগ্র গ্রাম। তারপর জীবিত থাকা পুরুষ-মহিলাদের নিয়ে ঢোকানো হত নৌকার পাটাতনের নীচে। দুই দিন আর পৃথিবীর আলো বাতাস চোখে পড়ে না। সকাল-সন্ধ্যা খাবার হিসেবে পেত এক মুঠো চাল। মরে গেলেও দস্যুদের মাথা ব্যথা নেই। এক মুঠো চাল খেয়ে যারা বেঁচে থাকত তাদেরকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা হত।

এ ছিল তৎকালীন বাংলার নদী তীরের গ্রামগুলোর নির্মম বাস্তবতা। তৎকালীন সময়ে মগ ও হার্মাদ জলদস্যুদের হামলাকে প্রতিহত করতে আর বিক্রমপুরকে (মুন্সিগঞ্জের পূর্বনাম) মুঘলদের করতলে রাখতে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর আমলে বাংলার সুবেদার ও সেনাপতি মীর জুমলা নির্মাণ করেন ইদ্রাকপুর কেল্লা। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ সমগ্র এলাকাকে রক্ষা করতে ১৬৬০ সালে মুন্সিগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ সদরে অবস্থিত) ইছামতী নদীর তীরে ইদ্রাকপুর নামক স্থানে নির্মাণ করা হয় ইদ্রাকপুর কেল্লা।

ধারণা করা হয় সুবাদার ইসলাম খান, বাংলায় মুঘল নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া শুরু করেন এবং একজন নৌপ্রধান বা মীর-ই-বহর নিয়োগ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তি ১০০ বছরে তিনটি দূর্গ গড়ে ওঠে যার একটি হলো ইদ্রাকপুর দূর্গ (অন্য দু'টি হাজিগঞ্জ দূর্গ ও সোনাকান্দা দূর্গ)। নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে অবস্থিত। এটি খিজিরপুর দুর্গ নামেও পরিচিত।

জলদুর্গের বৈশিষ্ট্য মন্ডিত দুর্গটি শীতলক্ষ্যার সঙ্গে পুরাতন বুড়িগঙ্গার সঙ্গমস্থলে নির্মিত হয়। সম্ভবত মুগল সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় মুগল রাজধানী স্থাপনের অব্যবহিত পরে নদীপথে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে দুর্গটি নির্মিত হয়। চতুর্ভুজাকৃতির এই দুর্গের পঞ্চভুজি বেষ্টন-প্রাচীরে রয়েছে বন্দুক ঢুকিয়ে গুলি চালাবার উপযোগী ফোকর এবং চারকোণে গোলাকার বুরুজ।

প্রাচীরের চারদিকে অভ্যন্তরভাগে দেয়ালের ভিত থেকে ১.২২ মিটার উঁচুতে রয়েছে চলাচলের পথ এবং এর দেয়ালেও আছে গুলি চালাবার উপযোগী ফোকর। চারকোণের প্রতিটি বুরুজের অভ্যন্তরভাগে দুর্গ প্রাচীরের শীর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত সিঁড়ি এবং এর বপ্র বহির্গত অংশে রয়েছে বন্দুকে গুলি চালাবার প্রশস্ততর ফোকর। সুউচ্চ প্রাচীরবিশিষ্ট এই দুর্গের প্রত্যেক কোনায় রয়েছে একটি বৃত্তাকার বেষ্টনী।

একমাত্র খিলানাকার দরজাটির অবস্থান উত্তর দিকে। মূল প্রাচীরের পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে ৩৩ মিটার ব্যাসের একটি গোলাকার উঁচু মঞ্চ রয়েছে। দূর থেকে শত্রুর চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য প্রায় প্রতি দুর্গে এই ব্যবস্থা ছিল। এই মঞ্চকে ঘিরে আর একটি অতিরিক্ত প্রাচীর মূল দেয়ালের সাথে মিলিত হয়েছে। দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সূদৃঢ় করার জন্য এটি নির্মিত হয়েছিল।

দুর্গের চতুর্ভুজাকৃতির অঙ্গনের এক কোণে রয়েছে ইটের তৈরি একটি সুউচ্চ চৌকা স্তম্ভ। এটি সম্ভবত একটি পর্যবেক্ষণ বুরুজ। এই স্তম্ভের অবস্থান থেকেই দুর্গটিকে সমসাময়িক অপরাপর জলদুর্গের সমগোত্রীয় বলে ধরে নেয়া যায়। কামান বসানোর উপযোগী উঁচু বেদীর অবস্থান দুর্গটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। নদীর দিকে দুর্গের একমাত্র প্রবেশপথ থেকে বোঝা যায় যে, শুধুমাত্র নদীপথেই দুর্গের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল। ফটকটির আয়াতাকার কাঠামোতে রয়েছে পঞ্চভূজি প্রবেশপথ।

প্রবেশপথের দু’পাশে রয়েছে খোদাই করা আয়তাকার খিলান এবং এর শীর্ষভাগ পদ্মফুলের অলঙ্করণ শোভিত। দুর্গের অভ্যন্তরে অপর কোনো নির্মাণ কাঠামো না থাকায় প্রতীয়মান হয় যে, বর্ষা মৌসুমে যখন জলদস্যুদের আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিত কেবলমাত্র তখনই দুর্গটিতে সৈন্য মোতায়েন করা হতো এবং সৈন্যরা সেখানে তাঁবুতে আশ্রয় নিত। কেল্লাটির তিন কিলোমিটারের মধ্যেই ইছামতী, ধলেশ্বরী, মেঘনা এবং শীতলক্ষা নদীর অবস্থান। মোঘল স্থাপত্যের একটি অনন্য কীর্তি হিসেবে ইদ্রাকপুর দুর্গটি ১৯০৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়। দুর্গ এলাকার ব্যাপক অংশ জুড়ে এখন রয়েছে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার ব্রিগেড সদর দফতর।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password