পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ১৬ বছর ধরে বন্দি বিডিআরের সাবেক ৪৩ জন জওয়ান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে ৪১ জন ও বেলা ৩টার দিকে ২ জন কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। মুক্তির পর অপেক্ষমাণ স্বজনরা তাদের ফুল দিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে বরণ করে নেন।
এ সময় সেখানে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ১৬ বছর পর প্রিয়জনকে কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার একেএম মাসুম জানান, জামিনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে বৃহস্পতিবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ৪৩ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কারাগার থেকে বেরিয়ে নায়েক সিগন্যাল ময়নুল হক বলেন, আজ নতুন জীবন পেলাম।
এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। তাকে বরণ করে নিতে অন্যান্য স্বজনের সঙ্গে কারাগারে এসেছেন ছেলে শিহাব ও মেয়ে সালেহা। ময়নুল হক কারাগারে যাওয়ার সময় শিহাবের বয়স ছিল ৫ আর সালেহার বয়স ছিল ৩ মাস। শিহাব এখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র আর সালেহা দশম শ্রেণির ছাত্রী।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর বাবাকে কাছে পেয়ে তারা বাকরুদ্ধ। চোখের কোণে জমেছে আনন্দাশ্রু। এইচএসসি পাশ করে ১৮ বছর বয়সে বিডিআরে সৈনিক পদে যোগ দেন জাহিদ। ১৬ পর আজ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় তিনি বলেন, সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া। বিনা অপরাধে এতগুলো বছর জীবন থেকে হারিয়ে গেল।
আ. খালেক বলেন, কত যে হয়রানি অপমানের মধ্য দিয়ে এতগুলো বছর পার করেছি তা আর কী বলব। তারপরও ছেলেকে মুক্ত দেখতে পেয়েছি, এখন মরেও সুখ পাব। ১৬ বছরে ৩২টা ঈদ আমরা কারাগারের সামনে কাটিয়েছি। আজকে ঈদের চেয়েও বেশি খুশি লাগছে। স্বজনদের পাশাপাশি বিডিআর জওয়ানদের বরণ করতে কারাগারের সামনে দেখা যায় বিডিআর কল্যাণ পরিষদ নেতাদের।
পরিষদের সভাপতি ফয়জুল আলম বলেন, আমি নিজেও জেল খেটে ৬ বছর আগে মুক্তি পেয়েছি। সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ৩টি দাবি রয়েছে।
দাবিগুলো হলো- নিরপরাধ যারা এখনো বন্দি রয়েছেন তাদের মুক্তি দিতে হবে। কারামুক্ত বিডিআর জওয়ানদের ক্ষতিপূরণ ও চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে। পাশাপাশি পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। জানা যায়, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এই সদস্যরা হত্যা মামলায় খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলার কারণে কারাগারে আটকে ছিলেন প্রায় ১৬ বছর ধরে।
বুধবার তাদের জামিননামা দাখিল করা হয়। এরপর তাদের জামিন সংক্রান্ত নথিপত্র কারাগারে গেলে শুরু হয় মুক্তির প্রস্তুতি। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে ওই ঘটনা। সেই বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষাবাহিনী বিডিআরের নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এই বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।
বিদ্রোহের বিচার বিজিবির আদালতে হলেও হত্যাকাণ্ডের মামলা বিচারের জন্য আসে প্রচলিত আদালতে। এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে মুক্তি আটকে যায় ৪৬৮ বিডিআর সদস্যের। বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে; কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
এ কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়। অন্যদিকে হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাইকোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরও ২২৮ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন।
হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন। হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন। অন্যদিকে হাইকোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়।
ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুনঃতদন্তের দাবি জোরালো হয়। এরপর ওই হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্তে গত ২৪ ডিসেম্বর আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করে দেয় সরকার। কমিশনকে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন