সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের বিনা পয়সায় কৃষকদের ধান কেটে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা

সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের  বিনা পয়সায় কৃষকদের ধান কেটে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা

গত বছর করোনা আর তিন দফা বন্যায় ক্ষতি পুষিয়ে না উঠতেই আবারও সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের কৃষকের মাথায় হাত। ধানকাটার মৌসুম শুরু হলেও করোনার ঊর্ধ্বমুখী রোধে দেশব্যাপী লকডাউন থাকায় দেখা দিয়েছে শ্রমিক সঙ্কট। এ অবস্থায় কৃষকদের পাশ দাঁড়িয়েছেন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নিজেদের জমির পাশাপাশি বিনা পারিশ্রমিকে অন্যের ধানও কেটে দিচ্ছেন তারা।জেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, সুনামগঞ্জে এবার তিন লাখ ২৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে ধানের চাষাবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক উৎপাদন হলে কেবল সুনামগঞ্জ নয় সারাদেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখবে এই জেলা।

হাওরে গিয়ে কথা হয় স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থী কামরুল হাসানের সঙ্গে। তিনি জানান, পড়ালেখার পাশাপাশি কামরুল ছোটখাটো চাকরি করতেন। লকডাউনে চাকরিটা চলে যায়। তাই তিনি এখন বাবার ফলানো পাকা ধান কাটছেন। পাশাপাশি অন্যের ধানও কেটে দিচ্ছেন।জেলার শাল্লা উপজেলার ডুমরা গ্রামের বাসিন্দা রিংকু তালুকদার। সিলেট মদন মোহন কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিংকু টিউশনি করেই নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতেন।

তিনি জানান, প্রায় এক বছর ধরেই টিউশনি নেই তার। গত বৈশাখেও বাড়িতে থেকে ধান কাটার কাজ করেছেন তিনি। এবার গ্রামের অন্য শিক্ষার্থীদের আগ্রহে কয়েকটা গ্রুপ করেছেন তারা।রিংকু আরও জানান, তাদের ১৪ জনের গ্রুপ। সবাই বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গ্রুপের অন্যরা হলেন- মদন মোহন কলেজের শিক্ষার্থী বিপ্লব তালুকদার, বিজন তালুকদার, শাল্লা ডিগ্রি কলেজের বেনু মধাব দাস, সীমান্ত তালুকদার, বিনয় তালুকদার ও রাব্বি মিয়া, নেত্রকোনার কালিয়াজুরির কৃষ্ণপুর কলেজের রুবেল তালুকদার, আশিক সরকার ও পাবেল মিয়া, সিলেটের এমসি কলেজের শিক্ষার্থী নিলয় কান্তি দাশ, রফিক মিয়া ও আকাশ দাশ, শাল্লা শাহেদ আলী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী মিঠু চন্দ্র দাশ।

দলের সদস্য পাভেল মিয়া জানান, ভোর ৬টা থেকেই তাদের ১৪ জনের দল ধানকাটা শুরু করেন। দুপুরে কাটা ধান মাড়াই করার স্থানে (খলায়) নিয়ে যান। খাওয়া দাওয়া শেষে আবার হাওরে ধানকাটা শুরু হয়। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এরপর আবার খলায় গিয়ে মেশিনে রাত ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মাড়াইয়ের কাজ হয়। সদস্যদের নিজেদের ধান পাকলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাটার সিদ্ধান্ত রয়েছে তাদের। অন্যদের ধানও কেটে দিচ্ছেন তারা।শাল্লার ডুমরা গ্রামের কৃষক পরিমল দাশ বলেন, ‘আমাদের এখানকার কৃষকরা পাবনা, কিশোরগঞ্জসহ অন্য জেলার শ্রমিকদের দিয়েই ধান কাটান। এবার লকডাউনের জন্য অনেক শ্রমিকের আসা হয়নি এই এলাকায়। তাতেও তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না। গ্রামের শিক্ষিত তরুণরাই নেমেছে ধান কাটায়।’

হাওরের আরেক স্থানে গিয়ে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের পাঁচ সদস্যের একটি দল ধান কাটায় ব্যস্ত। এতে আছেন হাছনবাহার গ্রামের বাসিন্দা সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আবুল কাহার, একই শ্রেণির শিক্ষার্থী বাবুল মিয়া, একই কলেজের ইতিহাস প্রথম বিভাগের শিক্ষার্থী মুহিত মিয়া, হাছনবাহার গ্রামের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাছুম মিয়া ও সাজ্জাদ মিয়া।সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘ধানকাটার জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়েছি আমরা। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ তাতে সাড়া দিয়েছে। শিক্ষার্থীরাও নেমেছে।’জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক ফরিদুল হাসান সাংবাদিককে বলেন, ‘এবার লকডাউনের সময়ে হাওরে গেলে গর্ব হয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পরিশ্রম দেখে। অভিবাদন তাদের।’

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password