দেশে রাইড শেয়ারিংয়ের নামে রমরমা ব্যবসা

দেশে রাইড শেয়ারিংয়ের নামে রমরমা ব্যবসা

স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারীদের হাতের নাগালেই অ্যাপস। ঘরে বসে অনুরোধ পাঠালে গাড়ি এসে হাজির, কোনো দামদর নেই; কিন্তু নিশ্চিন্তে পৌঁছে যাওয়া যায় গন্তব্যে। যাত্রী পরিবহণের এই সেবাকে রাইড শেয়ারিং নাম দিলেও আসলেই রাইড কি শেয়ার করছেন এই সেবাদানকারী চালকেরা? অন্তত ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে না। কোনো যাত্রী নিজে কোথাও যাচ্ছেন, এমন ক্ষেত্রে সে পথের কাউকে নেওয়াই হলো শেয়ারিং। সেবাগ্রহণকারীরা বলছেন, এখন পাঠাও-উবার যা করছে তা কোনোভাবেই শেয়ারিং নয়; বরং কথ্য বাংলায় যাকে 'খ্যাপ' বলা হয় থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এই সময় বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রাইড শেয়ারিং সেবা। অনেক দেশেই এটি কারপুলিং, কস্ট শেয়ারিং নামেও পরিচিত। জ্বালানি, সময়, অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি পরিবেশের ক্ষতি কম হওয়ায় দ্রম্নত বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পায় মাধ্যমটি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে এই সেবা চালু হলেও সেবা প্রদান ও গ্রহণকারীদের রয়েছে নানা অভিযোগ। সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে রাইড শেয়ারিং সেবার নামে দেশে যা চলছে তা আসলে ব্যবসা।?

বাংলাদেশের গণপরিবহণ ব্যবস্থার নৈরাজ্যের কারণে বিকল্প হিসেবে অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পায় এই রাইড শেয়ারিং নামে যাত্রী পরিবহণ ব্যবস্থা। দেখা গেছে রাজধানী ঢাকায় প্রয়োজনের সময়ে সিএনজি অটোরিকশা, ট্যাক্সি, রিকশা, কোনো কিছুই হাতের নাগালে থাকে না। এছাড়া বৃষ্টি, রাজনৈতিক অস্থিরতা,

সমাবেশ বা বড় কোনো পরীক্ষা থাকলে যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়ে যায় বহুগুণ।

তবে এই সেবায় নিরাপত্তা, জবাবদিহিতাসহ নানা বিষয়ে যাত্রীদের রয়েছে অভিযোগের ঝুড়ি। ইউনিলিভারের করপোরেট শাখার কর্মকর্তা হাসান শেখ নিয়মিত রাইড শেয়ারিং সেবা নিয়ে থাকেন। হাসান শেখের অভিযোগ গতি ও নিরাপত্তা নিয়ে। তিনি জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মোটরবাইক চালকেরা যাত্রীদের নামে মাত্র হেলমেট দেন। সম্প্রতি রাইড শেয়ারিং সেবা নিতে গিয়ে চোখে প্রচন্ড আঘাত পান তিনি। মোটরবাইকটি চলা অবস্থায় কোনো একটি বস্তু তার চোখে এসে লাগলে তার ডান চোখটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাকের শিক্ষার্থী সামিয়া আজাদ প্রশ্ন তুলেছেন চালকের ব্যবহার নিয়ে। এছাড়া প্রশ্ন তুলেছেন গাড়ির নম্বর ও অ্যাপসে দেওয়া চালকের আইডির সঙ্গে সেবা প্রদানকারী চালকের মিল না থাকা বিষয়টি নিয়েও।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জামিল হায়দারের অভিযোগ রাস্তায় চালকদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতার বিষয়টি নিয়ে। রাইড শেয়ারিং সেবা নিয়ে থাকেন এরকম যাত্রীদের আরও অভিযোগের মধ্যে অন্যতম অভিযোগ অ্যাপসের রাইড শেয়ারিং অনুরোধ গ্রহণের পর যাত্রী নেওয়ার সময় তারা (চালকরা) রিকোয়েস্ট বাতিল করে অফ লাইনে যেত চায়। এছাড়া সরেজমিনে দেখা যায়, এসব চালকের অধিকাংশই অ্যাপসে যাত্রী নিতে আগ্রহী নন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা চুক্তিতে যেতে চায়, যা যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। কারণ কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট চালক ও যাত্রীর কোনো তথ্যই কারও কাছে থাকে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কারপুলিং বা রাইড শেয়ারিং-এ কোনোভাবেই একজন চালকের মুনাফা করার কথা না। শুধু যাত্রাপথে জ্বালানির খরচের এক অংশ দেওয়ার কথা সহযাত্রীর কিন্তু বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিংয়ের নামে রীতিমতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন চালকেরা। শুধু চালক নন, একটা অ্যাপ বানিয়ে আর কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই কামাচ্ছেন নগদ টাকা।

এ বিষয়ে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক এবং যোগাযোগ ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ইফতেখার হাসেম বিডিটাইপকে বলেন, যদি রাইড শেয়ার করতে হয়, সেটা অবশ্যই দারুণ উদ্যোগ আর যদি এখন যা চলছে তাই চলতে দিতে হয়, তাহলে শেয়ারিংয়ের মুখোশ ছেড়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেই তাদের নিবন্ধন করতে হবে। এরা মূলত রাইড শেয়ারিংয়ের নামে টাকা কামিয়ে ট্যাক্স ফাঁকি ও অন্যদিকে জনগণের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল চৌধুরী বিডিটাইপকে বলেন, মূলত কর্মসংস্থানের অভাবে দেশে রাইড শেয়ারিং সেবা খাঁটি ব্যবসায় রূপ নিয়েছে। প্রথম এক বছর নিয়মকানুন কিছুটা মানা হলেও সরকার ও সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় এই সেবায় যাত্রী ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।

রাইড শেয়ারিং-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে সহজ রাইড শেয়ারিংয়ের এক নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, যাত্রীসেবায় তাদের অ্যাপস ব্যবহার করেন তারা নির্দিষ্ট রাইড শেষ করেই অভিযোগ কিংবা মতামত জানাতে পারেন। তবে যারা অ্যাপস ব্যবহার না করে অফ লাইনে যাত্রীসেবা দিয়ে এবং নিয়ে থাকেন সে বিষয়ে তাদের কিছুই করার থাকে না। দেখা গেছে, অফ লাইন কিংবা চুক্তিতে যাত্রী পরিবহণের ক্ষেত্রে বাড়তি ভাড়া নেওয়াসহ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। এজন্য যাত্রীদের চুক্তিতে রাইড শেয়ারিং সেবা না নেওয়ার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।

চালকদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা ও একটা আইডি বহু চালকের ব্যবহার প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, সহজ রাইডের অ্যাপস নিবন্ধনের ক্ষেত্রে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ সব ধরনের কাগজপত্র যাচাই করা হয়। আর একজনের আইডি অন্যজন ব্যবহার করার অভিযোগ করা হলে ওই আইডি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রাইড শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ অভিযোগ মোটরবাইককেন্দ্রিক। তবে রাস্তায় মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে যারা ট্রিপ দিয়ে থাকেন এসব চালকের অধিকাংশেরই কোনো অ্যাপস নিবন্ধন নেই- এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এসব চালকই মূলত বাড়তি ভাড়া আদায়সহ যাত্রী হয়রানি করে।

এদিকে ২০১৬ সালের শেষের দিকে যাত্রা শুরু করে দেশের বৃহত্তম রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাও। পাঠাও জানিয়েছে, এই পর্যন্ত তাদের মোবাইল অ্যাপ প্রায় ৫০ লাখ বার ডাউনলোড হয়েছে। ৪ কোটির বেশি ট্রিপ দিয়েছেন পাঠাওয়ের চালকরা। রাইড শেয়ারিংয়ের পাশাপাশি খাবার ও পার্সেল সার্ভিস রয়েছে পাঠাওয়ের। এছাড়া নেপালেও চলছে তাদের কার্যক্রম। এই সেবায় পরে উবার, সহজসহ আরও বেশ কিছু দেশীয় প্রতিষ্ঠান যোগ হয়।

বাংলাদেশের পরিবহণ ব্যবসায় রাইড শেয়ারিং খাতের শেয়ার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা, যা পরিবহণ খাতের ২৩ শতাংশ। এ ধরনের ওয়েব-ভিত্তিক পস্ন্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে স্টার্ট-আপগুলো অর্থনীতির নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। লিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং শিল্পের মূল্যমান আনুমানিক ২,২০০ কোটি টাকা এবং পরিবহণ খাতের ২৩ শতাংশেরই অংশ। জানুয়ারি ২০১৯-এর তথ্য অনুসারে, যাত্রীরা রাইড শেয়ারিং অ্যাপসের মাধ্যমে প্রতি মাসে গড়ে ৬ মিলিয়ন রাইড নিয়েছিল। বর্তমানে তা ৬ মিলিয়ন ছাড়িয়ে মাসে ৭.৫ মিলিয়ন যাত্রায় পৌঁছেছে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password