৩ লাখ টাকায় যমজ নবজাতককে বিক্রি করে দিয়েছিলেন মা-বাবা। টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে মামলা হলে ফাঁস হয় ঘটনা। চট্টগ্রাম পিবিআই’য়ের তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর কাহিনী। গ্রেফতার হন শিশুর বাবা ও মধ্যস্থতাকারি নারী।
সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় বাবা-মা। আর সেই বাবা-মা-ই স্ট্যাম্পে সই করে বিক্রি করে দিয়েছে জমজ দুই শিশুকে। তিন লাখ টাকায় বিক্রির পর, সেই টাকা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় স্বামী-স্ত্রীর। এর সূত্র ধরে চট্টগ্রামে শিশু কেনাবেচার চক্রের খোঁজ পায় পিবিআই। জমজ ২ শিশুকে উদ্ধারের পাশাপাশি গ্রেপ্তার করা হয় দুইজনকে।
বলা হয়ে থাকে, মায়ের কাছেই সন্তান সবচেয়ে নিরাপদ। মা-ই সন্তানের সবচেয়ে আপনজন। কিন্তু টাকার লোভে পড়ে মুন্নী আকতার নামের এক মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার জমজ সন্তান জন্ম হলেই বিক্রি করে দেবেন। সে অনুযায়ী সবকিছু ঠিকও করা হয়েছিল।
বিষয়টি স্বামী হাবিবুর রহমানকে জানালে তিনিও টাকার বিনিময়ে নিজের সন্তানদের বিক্রিতে ‘হ্যা’ বলেন। যেই কথা সেই কাজ। পাঁচ মাস আগে সন্তান জন্ম নিতেই দুই নারীর কাছে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন এই দম্পত্তি। বিষয়টি এতদিন অজানাই ছিল। কিন্তু সেই অজানার বদ্ধ দুয়ার খুলে দিলেন মা নিজেই। মায়ের এই ‘পল্টি মারা’ একটাই কারণে।
কিছুদিন আগে মুন্নীকে মারধর করে সন্তান বিক্রির টাকার অর্ধেক অর্থাৎ দেড় লাখ টাকা নিয়ে নেন তার স্বামী। এতেই ক্ষিপ্ত হন মুন্নী। আর দেরি করেননি এই নারী, স্বামীসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল, চট্টগ্রামে মামলা ঠুকে দেন। সেই মামলার তদন্তে নেমে অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার বি.এ হেডমাস্টার বাড়ি থেকে রায়ান এবং নগরীর অক্সিজেন এলাকা থেকে ফাহমিদা নামের দুই শিশুকে উদ্ধার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। জমজ দুই শিশুরই বয়স ৫ মাস ৫ দিন।
রোববার (৯ জুন) দুই শিশুকে উদ্ধার এবং তাদের বিক্রি করে দেওয়ার সেই লোমহর্ষক ঘটনা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন পিবিআই, চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা। পিবিআই সূত্র জানায়, সম্প্রতি মুন্নী আকতার মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল মানবপাচার আইনে মামলাটি করেন।
সেই মামলায় তিনি উল্লেখ করেন গত ৩ জানুয়ারি সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে নগরীর পাঁচলাইশ এলাকার পলি হাসপাতালে তার জমজ (১ ছেলে, ১ মেয়ে) সন্তান প্রসব হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক রোকসানা আকতার ও মামুন এবং তার স্বামী মো. হাবিবুর রহমান বাচ্চা প্রসবের পরপরই অজ্ঞাতনামা ৩ জন নারীর হাতে তাদের তুলে দেন।
এই সময় মুন্নীর আরেক মেয়ে রূমা আকতার প্রতিবাদ করলে তাকে ও তার ছোট ভাই রেহানকে তাদের বাবা হাসপাতালের বাথরুমে আটক রাখেন। তখন মুন্নী শিশুদের বিষয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক রোকসানা আকতার ও মামুনের কাছে জানতে চাইলে তারা বাচ্চা দুটি অসুস্থ থাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের বাবা হাবিবুর রহমান চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন বলে জানান।
কিন্তু পরে জমজ বাচ্চাদের ফিরে না পেয়ে তিনি মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন। মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন। পিবিআই মামলার তদন্তে নেমে দেখতে পায়, জমজ শিশু বিক্রির ঘটনায় মাও জড়িত।
পিবিআই, চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা জানান, মামলাটি তদন্তের সময় প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণে জানা যায় যে, মামলার বাদী মুন্নী বাবুর্চির সহকারী হিসেবে কাজসহ বাসা বাড়ীতে গৃহকর্মীর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার আগের সংসারে একটি মেয়ে ছিল। চার বছর আগে হাবিবুর রহমানকে বিয়ে করেন।
সেই হাবিবুর রহমানেরও আগের সংসারে দুটি বাচ্চা ছিল। এক পর্যায়ে হাবিবুরের সংসারে মুন্নী সন্তান সম্ভবা হন। অন্যদিকে বহুদিন ধরে রাঙ্গুনিয়ার হেডমাস্টার বাড়ির শিরু আকতারের কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় তিনি নবজাতক পুত্র সন্তান দত্তক নেওয়ার জন্য খুঁজছিলেন।
একইভাবে নগরীর মোহরা এলাকার রুনা আকতারের কোনো মেয়ে সন্তান না থাকায় তিনিও একজন নবজাতক কন্যা সন্তান দত্তক নেওয়ার জন্য খুঁজছিলেন। এই দুই নারীর সঙ্গে ঘটনাক্রমে সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের বাসিন্দা বাচ্চা বেচাকেনা চক্রের সঙ্গে জড়িত রাশেদা বেগমের সঙ্গে পরিচয় হয়।
রাশেদা বেগম তাদের উভয়কে আশ্বস্ত করে যে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিলে তিনি তাদের উভয়কে তাদের পছন্দমত নবজাতক ছেলেমেয়ে দত্তক এনে দিতে পারবেন। নাইমা সুলতানা বলেন, ‘এক পর্যায়ে রাশেদা সন্তানসম্ভাবা মুন্নীর সঙ্গে শিরু ও রুনাকে পরিচয় করিয়ে দেন। নবজাতক ছেলের বিনিময়ে শিরু ৩ লাখ টাকা এবং রুনা নবজাতক মেয়ের বিনিময়ে ১ লাখ টাকা দিতে রাজি হন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মুন্নী ১ ছেলে সন্তান ও ১টি কন্যা সন্তান প্রসব করলে ছেলে সন্তানকে শিরু আকতারের নিকট এবং কন্যা সন্তানকে রুনা আকতারের নিকট দত্তক দেন। চার লাখ টাকায় চুক্তি হলেও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রাশেদাকে ১ লাখ টাকা দিতে হয় মুন্নীকে। ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে বাদীর স্বামী মামলার ১ নম্বর আসামি হাবিবুর রহমান তাকে মারধর করে দেড় লাখ টাকা নিয়ে যান। এরপর ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেন মুন্নী।’
পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, ‘পাঁচ মাস আগে বাচ্চাগুলো বিক্রি করে দেওয়া হলেও মা মুন্নী আকতার মামলা করেন একমাস আগে। যেহেতু মানবপাচার আইনে মামলা, সেজন্য আমরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে মামলাটি তদন্ত করতে থাকি। এক পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনকে মুখোমুখী করার পর দেখতে পাই, মানবপাচার না, বাচ্চা চুরি বেচাকেনা চক্রের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে বাচ্চা দুটিকে বিক্রি করে দিয়েছেন দুজনে।’
কেন মাববপাচার মামলা করতে গেলেন সেই বিষয়ে অনুসন্ধান করে পিবিআই জানতে পারে মুন্নীর কৌশলের কথা। নাইম সুলতানা বলেন, ‘মুন্নী তার স্বামীকে বলেছিলেন দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে বাচ্চাদের বিক্রি করেছেন। সে অনুযায়ী তিন লাখ টাকার মধ্যে দেড় লাখ টাকা সরিয়ে রাখেন মুন্নী। কিন্তু এক পর্যায়ে হাবিবুর রহমান জানতে পারেন দেড় লাখ নয়, তিন লাখেই বাচ্চাদের বিক্রি করেছেন মুন্নী। কিন্তু হাবিবুর রহমান জানতে পেরে মারধর করে সেই দেড় লাখ টাকা কেড়ে নেন মুন্নীর কাছ থেকে। পরে সেই টাকায় তার আগের সংসারে থাকা এক মেয়েকে বিয়েও দেন। বিষয়টি মানতে না পেরে মানবপাচার আইনে মামলা করে দেন মুন্নী।’
পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে জমজ সন্তানের মা-বাবা ছাড়াও টাকার বিনিময়ে দত্তক নেওয়া দুই নারী শিরু ও রুনা এবং মধ্যস্থতাকারী রাশেদাকে আনা হয়। কেন এই কাজে জড়ালেন এমন প্রশ্নে মধ্যস্থতাকারী রাশেদা বেগম বলেন, ‘ওই দুই নারী বহুদিন ধরে সন্তান দত্তক নেওয়ার জন্য খুঁজছিলেন। এক পর্যায়ে আমার সঙ্গে পরিচয় হলে আমি মুন্নীর সঙ্গে কথা বলি। তিনি তিন লাখ টাকার বিনিময়ে ছেলে এবং এক লাখ টাকার বিনিময়ে মেয়েকে দত্তক দিতে রাজি হন।
এক লাখ টাকা আমাকেও দেন। কিন্তু মুন্নী আমাদের জানিয়ে দেন তার স্বামীকে যেন বলি দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। বাকি দেড় লাখ টাকার কথা তিনি যেন না জানেন। পরে হয়তো স্বামী বিষয়টি জানলে তাদের মধ্যে ঝামেলা হয়।’ এর আগেও রাশেদাকে আরেকবার ধরেছিল পুলিশ। তখনও বাচ্চা চুরির সন্দেহজনক হিসেবে তাকে আটক করা হয়েছিল।
তখন তার কোনো দোষ খুঁজে না পেলেও এবার অবশ্য রাশেদা ফেঁসে গেছেন। এই বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদা বলেন, ‘আমি তো বাচ্চা চুরি করিনি। ওরা দুজন (শিশুর মা-বাবা) স্বাক্ষর করে চুক্তিপত্র করেই বাচ্চা দত্তক দিয়েছেন।’ কেন বাচ্চাদের বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমন প্রশ্নে জমজ শিশুর মা মুন্নী আকতার বলেন, ‘আমি বাচ্চার বিক্রির সিদ্ধান্ত কখনো নিতাম না।
আমার স্বামী আমাকে চাচ্ছিল না, তখন আমি যে বাসায় কাজ করতাম সেই বাসার গৃহকর্তী আমাকে অসুস্থ দেখে তার বাসা থেকে আসতে দিতেন না। বাচ্চাগুলো হলে আমাদের দিয়ে দেবেন, বিনিময়ে আমরা আপনাকে দেখব। আপনি এখানেই থাকবেন, স্বামীর কাছে আর যেতে পারবেন না। পাশাপাশি তারা আমার আগের এক ছেলে ও এক মেয়েকেও দেখভাল করছিল।’ তবে মুন্নী দাবি করেন তিনি নিজের ইচ্ছেয় বাচ্চা বিক্রি করেননি।
বলেন, ‘আমি যদি বাচ্চা বিক্রি করতাম, তাহলে আমি কেন আদালতে গিয়ে মামলা করব? আমি টাকার ভাগ নিইনি, কে টাকা নিয়েছে সেটাও জানি না।’ তখন পাশে দাঁড়ানো রাশেদা বেগম সেটির প্রতিবাদ করে বলেন, ‘এখন পুরোটাই মিথ্যা বলছেন মুন্নী। তিনি নিজের ইচ্ছেতেই টাকার বিনিময়ে বাচ্চাদের দত্তক দিয়েছেন।’ দুই বাচ্চাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে পিবিআই।
আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রায়ান ও ফাহমিদার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে-তারা কি মা মুন্নী আকতারের কোলেই ফিরবে, নাকি থাকবে দত্তক নেওয়া দুই নারীর কাছেই। পিবিআই কার্যালয়ে দত্তক নেওয়া দুই নারীর কোলে বসে কখনো হাসছিল, কখনো বা আবার কেঁদে কেঁদে উঠছিল। নতুন মায়েরা তাদের সেই কান্না থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
তারই অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল পিবিআইয়ের হেফাজতে থাকা তাদের আসল মা মুন্নী আকতার। মুন্নীর চোখেমুখে বাচ্চাদের ফিরে পাওয়ার কোনো আকুতিই যেন ছিল না, তার মনে যেন দেড় লাখ টাকা কেড়ে নেওয়া স্বামী হাবিবুর রহমানকে কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায় সেই প্রচেষ্টা!
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন