বিশ্বের কুখ্যাত খুনি মনজু মামা

বিশ্বের কুখ্যাত খুনি মনজু মামা

ইংল্যান্ডের জন জর্জ হাই, ইকুয়েডরের পেদ্রো লোপেজ, কলম্বিয়ার লুইস গারাভিতো। তাঁরা বিশ্বের কুখ্যাত খুনি। এমন সব ভয়ংকর কিলারের কাতারে নাম লেখানোর অভিপ্রায় নিয়ে অপরাধজগতে পা ফেলেছিলেন তিনি। তবে প্রথম মিশনেই ধরা বগুড়ার অজপাড়াগাঁয়ের এই কিলার। তাঁর অ্যাডভেঞ্চারের কারণেই মা-বাবার বুক খালি করে না-ফেরার দেশে চলে গেছে অবুঝ এক শিশু।

ছিপছিপে গড়ন, পাষাণ হৃদয়, বয়স ৩৪। ঠাণ্ডা মাথার কিলার। নাম মনজু মিয়া। লেখাপড়ার দৌড় খুব বেশি নয়, টেনেটুনে এসএসসির গণ্ডি। পরে ২০১৩ সালে জীবিকার খোঁজে ওমানে পাড়ি জমান। সেখানেও খুব বেশিদিন টেকেনি মন। দেশে ফিরে বগুড়ার গাবতলীতে থিতু হন ওষুধের দোকানে। পরে ভারতীয় অপরাধবিষয়ক সিরিয়াল দেখে দেখে অপহরণ, হত্যা আর লাশ গুমের ‘ভূত’ মাথায় চাপে।

বিশ্বের বাঘা বাঘা কিলারের অপরাধকাজের পদ্ধতি অনুসরণ ও রপ্ত করতে থাকেন মনজু। প্রথম মিশনে ছয় বছরের শিশু হানজালাকে অপহরণের পর নির্মমভাবে হত্যা, শেষে লাশটি গুম করতে অভিনব সব প্রক্রিয়ার সহায়তা নেন মনজু। পরে মুক্তিপণ না পেয়ে তাঁরই দেওয়া তথ্য অনুসারে পুলিশ এক মাস আট দিন পর বাড়ির পাশের একটি ডোবা থেকে ওই শিশুর লাশ উদ্ধার করে। আর তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ এই খুনিকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের সময় লেগে যায় প্রায় সাড়ে তিন মাস। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বগুড়ার গাবতলীর নিশুপাড়া গ্রাম থেকে মনজু মিয়াকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।

কে এই মনজু : গাবতলীর নিশুপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল জব্বারের ছোট ছেলে মনজু। গাবতলী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাসের পর পড়ালেখা শিকেয় ওঠে। পরে ২০১৩ সালে শ্রমিক ভিসায় তিনি ওমান যান। সেখানে সাড়ে চার বছর থাকাকালে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও ক্রাইম সিরিজ দেখার প্রেমে পড়েন। একই সঙ্গে ‘ভয়েস চেঞ্জার’ অ্যাপ ব্যবহার করে কিভাবে পুরুষ কিংবা নারীকণ্ঠ বিকৃত করে কথা বলা যায়, সেটার দীক্ষা নেন।

যেভাবে হানজালাকে হত্যা : গেল বছরের ১৩ ডিসেম্বর। ওই দিন বিকেল থেকে গাবতলীর রামেশ্বরপুর ইউনিয়নের নিশুপাড়া গ্রামের পিন্টু প্রামাণিকের ছেলে হানজালাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সেদিনই হানজালার পরিবার গাবতলী থানায় জিডি করে। এক পর্যায়ে শিশুটির মা তাসলিমা বেগমের কাছে ফোনে মুক্তিপণ হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন অপহরণকারী মনজু। তবে সত্যতা না পাওয়ায় শিশুটির পরিবার অপহরণকারীকে টাকা দেয়নি। পরে অপহরণের ৩৮ দিন পর গত ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গাবতলীর নিশুপাড়া গ্রামের একটি ডোবা থেকে স্কচ টেপে পেঁচানো, পলিথিনে মোড়ানো ইট বেঁধে ডুবিয়ে রাখা অবস্থায় হানজালার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

প্রতিবেশী মনজুকে ‘মামা’ ডাকত হানজালা। এ কারণে সে প্রায়ই তাদের বাড়ির পাশের মনজুর ওষুধের দোকানে যেত। গত ১৩ ডিসেম্বর বিকেলে মনজু নিশুপাড়ায় ওষুধের দোকানে বসে ইয়াবা সেবন করছিলেন। এ সময় দোকানে গেলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হানজালার মুখে স্কচ টেপ লাগিয়ে বেঁধে ফেলেন। একপর্যায়ে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। পরে শিশুটির তুলতুলে শরীরের পুরোটাই স্কচ টেপ দিয়ে পেঁচিয়ে বিশেষ কায়দায় পিরামিড আকৃতি দেওয়া হয়। পচন রোধে বাতাস চলাচল বন্ধে সিল করা হয় পুরো শরীর। এরপর দোকানের একটি বাক্সের ভেতরে রেখে দেওয়া হয় লাশটি। ১২ ঘণ্টা পর গভীর রাতে লাশটি একটি বস্তায় ভরে পায়ের সঙ্গে তিনটি ইট বেঁধে বাড়ির পাশের একটি ডোবার পানিতে ফেলে রাখা হয়। মনজু লাশ গুম করার পরও ডোবার পাশে গিয়ে নিয়মিত লাশটি পর্যবেক্ষণ করতেন। মনজু অত্যন্ত চতুর। হানজালাকে খুন করার পরও তিনি ওই পরিবারের পাশে থেকেছেন। এলাকায় অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে যোগ দিয়েছেন। এমনকি একাধিকবার শিশুটির বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে তাঁদের তৎপরতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন।

ভারতীয় অপরাধবিষয়ক সিরিয়ালে মন : কে ডি পাঠক। ভারতের জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ‘আদালত’-এর প্রধান কুশীলব। অভিনেতার সাহস, বুদ্ধি আর অধ্যবসায়ে মুগ্ধ মনজু কে ডি পাঠকের দারুণ ভক্ত। ভারতীয় অপরাধবিষয়ক আরেকটি সিরিয়াল ‘ক্রাইম প্যাট্রল’-এর সব পর্ব তাঁর দেখা। এর মধ্যে ৬৬৫ নম্বর পর্বটি মনজুর আগাগোড়া মুখস্থ। প্রথম মিশনের জন্য মনজু ওই পর্ব বেছে নেন। আর ‘আদালত’ সিরিয়ালের মিসরীয় মমি সিরিজ দেখে লাশ সংরক্ষণের দীক্ষা নেন।

মনজুর জানা ছিল, বাতাসের সংস্পর্শে না এলে লাশের শরীরের কোষগুলোর পচনপ্রক্রিয়া থেমে যায়। ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় রাখা গেলে লাশ দুই থেকে ছয় মাস পর্যন্ত গন্ধহীন ও প্রায় অবিকৃত রাখা সম্ভব। মনজু পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি ‘আদালত’ সিরিজ দেখে মূলত লাশ সংরক্ষণের উপায় জেনেছেন। আর ক্রাইম প্যাট্রলের ৬৬৫ নম্বর পর্ব দেখে শিখেছেন কিভাবে একটি পরিবারের সঙ্গে মিশে গিয়ে বাড়ির শিশুসন্তানকে অপহরণ করা যায় এবং কোন উপায়ে লাশ গুম করে দাবি করা যায় মুক্তিপণ।

পুলিশের হাতে যেভাবে ধরা : খুন করে লাশ গুম করার ছয় দিন পর হানজালার পরিবারের সঙ্গে মুক্তিপণের জন্য যোগাযোগ করেন মনজু। এর আগে তিনি বগুড়া শহরে এসে মোবাইল ফোনের সিম কেনার জন্য গরিব অসহায় মানুষের খোঁজ নিতে শুরু করেন। পেয়ে যান পঙ্গু ফকির আনন্দ চন্দ্র দাস নামের একজনকে। তাঁকে প্রতিবন্ধী ভাতা পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে শহরের সাতমাথা থেকে আনন্দ চন্দ্রের নামেই গ্রামীণফোনের একটি সিমকার্ড কেনেন। এই সিম থেকে ঘটনার ছয় দিন পর হানজালার মাকে ফোন দেন মনজু। ম্যাজিক ভয়েসে গলার স্বর পাল্টিয়ে তিনি নিজেকে অপহরণকারী সদস্য পরিচয় দেন। ছেলেকে ফেরত নিতে হলে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন তিনি। পরে দফায় দফায় ওই পরিবারের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বললেও একই সিম নম্বর কিংবা এলাকা ব্যবহার করা হয়নি। ভিন্ন ভিন্ন নম্বর থেকে ফোন দিয়ে টাকা দাবি করলে হানজালার মায়ের সন্দেহ হয়। তিনি তাঁর ছেলের ছবি কিংবা ভিডিও দেখতে চান। মনজু এতে ব্যর্থ হলে পরিবার আর টাকা দেয়নি। পুলিশও অপহরণকারী ধরতে গলদঘর্ম হতে থাকে। কিন্তু পেশাদার খুনির মতোই চতুর মনজুর নাগাল পেতে পুলিশের সময় লেগে যায় প্রায় সাড়ে তিন মাস। এর আগে মোবাইল ফোনে মনজুর দেওয়া তথ্যে অপহরণের ৩৮ দিন পর বাড়ির পাশের ডোবা থেকে হানজালার লাশ উদ্ধার করা হয়। পায়ে ইট বাঁধা লাশটির শরীর একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় বাঁকানো ছিল। আশপাশের এলাকায় কোনো গন্ধ না ছড়ালেও পুরো শরীর টেপে মোড়ানো লাশটির মুখ ও শরীর বিকৃত হয়ে গিয়েছিল।

মনজুকে শনাক্ত করতে বগুড়া পুলিশের বিশেষ দলকে সাড়ে তিন মাসে তিন হাজার ৫০০ সিমের ওপর নজরদারি করতে হয়েছে। শেষে পাঁচটি নম্বর পুলিশ শনাক্ত করে। অভিযান চালিয়ে পুলিশ এসব সিমের মালিকের খোঁজ পেলেও তাদের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি জানতে পারে। এরই মধ্যে একটি ভুল করে বসেন মনজু। তিনি নতুন একটি সিমকার্ড দিয়ে ভয় দেখাতে ফোন করেন রামেশ্বরপুর ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্যকে। এ সময় তিনি একই মোবাইল সেট ব্যবহার করেন, যার আইডেন্টিফিকেশন নম্বর আগের নম্বরগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। পরে পুলিশ এই সিমকার্ড সংগ্রহকারী অতুল চন্দ্র দাসকে খুঁজে বের করে ওই দোকানে যায়। সেখানে সিসি ক্যামেরায় মুখে মাস্ক পরা অবস্থায় মনজুর দেখা মেলে। এরপর গত শুক্রবার সন্ধ্যায় গাবতলীর নিশুপাড়া গ্রাম থেকে মনজুকে ধরে আনে পুলিশ।

পুলিশ যা বলছে : বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, তাঁর ব্যবহৃত ডিভাইস মামলার স্বার্থে জব্দ করা হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু ক্লু মিলেছে। তাঁদের এই অভিযানে ডিবির ইনচার্জ আব্দুর রাজ্জাক, পরিদর্শক ইমরান মাহমুদ তুহিনসহ ডিবি পুলিশের একটি চৌকস দল কাজ করেছে। পুলিশ সুপার জানান, হানজালার বাবা পিন্টু প্রামাণিক চাকরি করতেন মালয়েশিয়ায়। ছেলে অপহরণের পর চলে আসেন দেশে। তাঁদের পরিবারটি মোটামুটি অবস্থাশালী। এ কারণেই মনজু ওই পরিবারের শিশুকে টার্গেট করেন। ইয়াবা সেবনের টাকা সংগ্রহ এবং ঋণ পরিশোধের জন্য মনজু ঘটনার ২০ দিন আগে অপহরণের পরিকল্পনা করেন। গতকাল আদালতে মনজু এ ঘটনার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password