ফের এসেছে এল নিনো! শেষবার এল নিনোর প্রভাবে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৮২ সালে। সে বছর পৃথিবীর এক প্রান্ত ডুবেছিল পানির নিচে আরেক প্রান্তে ছিল ভয়াবহ খরা, দাবানল ও ঝড়। ছোট বেলায় পড়েছিলাম- মজার দেশ এক যে ছিলো মজার দেশ, সব রকমে ভালো, রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো। এই কবিতাটির মতোই এখন বিশ্ব পরিস্থিতি।
বাংলাদেশে বেজায় রোদ আর আরব আমিরাতে বৃষ্টি। যদিও অনেকেই বলছেন, এটা কিয়ামতের আলামত। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন অন্য কথা। তুমুল বৃষ্টি ও ঝড়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাই অচল হয়ে পড়েছে। মরুর দেশে দেখা দিয়েছে বন্যা।
আর এদিক দিয়ে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যে দেশে ছয় ঋতু বিদ্যমান। তবে এখন বোঝার উপায় নেই কোনটা কোন ঋতু। কারণ শীতকালেও দেখা মিলে বৃষ্টির। বিষয়টি অনেকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও এটি মোটেও স্বাভাবিক বিষয় নয়। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও আবহাওয়াবিদরা বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিতই বটে। কারণ, পৃথিবী ‘এল নিনো’র ১১ ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
--এল নিনো’ মানে কী?-- এল নিনো একটি স্প্যানিশ শব্দ। যার মানে বালক। তবে নামে বালক হলেও এটি কোনো মানব নয়। এল নিনোর কারণে সমুদ্রমন্ডলে বিশাল পরিবর্তনকে বোঝানো হয়। ১৬ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের একদল জেলে প্রথম খেয়াল করেন এ উষ্ণ সমুদ্রজল। এরপর তাদের দেশে শুরু হয় প্রচুর বৃষ্টি। তারা জানতোই না তাদের থেকে দূরে বাংলাদেশ বা ভারতে ছিল খরা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ বরাবরই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকির তালিকায় অন্যতম। এরপর থেকে দুঃস্বপ্নের মতো পৃথিবীতে প্রায়ই ফিরে আসে এল নিনো দশা।
--কেন ‘এল নিনো’র শঙ্কায় কাঁপছে বিশ্ব?-- বর্তমানে এল নিনোর প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে চরম বিপর্যয় বয়ে নিয়ে এসেছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারনা। এতে পেরু, ইকুয়েডর ও চিলিসহ উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও উপকূলে ভাঙনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ফলে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বহু জায়গায় বৃষ্টিপাত কমে আসবে। দেখা দেবে শুষ্কতা। খরা ও দাবানলের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে বাংলাদেশ-ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোতে।
--এল নিনো’র প্রভাবে কি হতে পারে বাংলাদেশে?-- এল নিনোর প্রভাবে বৈশ্বিক জলবায়ুর অবস্থা বেসামাল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে, কিছু জায়গায় ৪২ ডিগ্রিও ছুঁয়েছে। প্রচন্ড তাপে পুড়ছে ফসলের মাঠ, ধান ও সবজির ক্ষেত। অসময়ে ঝরে যাচ্ছে ফলের মুকুল। বাড়ছে ডায়রিয়া, হিটস্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্তের সংখ্যা। চলতি বছরের জুলাই, আগস্ট বা সেপ্টেম্বর নাগাদ এল নিনো হওয়ার ৮০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে। অথবা অক্টোবর, নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ঘটতে পারে। যা-ই হোক না কেন, এল নিনোর একটি ব্যাপক বৈশ্বিক প্রভাব থাকবে। আর এই বছরের এল নিনোর কারণে বাংলাদেশে আগামী ছয় থেকে আট মাস স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ তাপমাত্রা, শুষ্ক জলবায়ু এমনকি ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপও বৃদ্ধি পেতে পারে।
--কেন ২০২৪ সাল ভয়াবহ?-- এল নিনোর প্রভাব ২০২৪ সালেই পড়তে শুরু করে বছরের শুরুতে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত এল নিনোর এই চক্র স্থানীয়ভাবে খরা ও ক্ষুধার পাশাপাশি প্রাণিবাহিত রোগ বাড়াবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। মশার উপদ্রব বাড়বে আরও বহুগুণে।
চলতি বছরেই ডেঙ্গুর যে ভয়াবহ অবস্থা তা এখন থেকেই পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। দেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের ৪৭ লাখেরও বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে।
২০১৯ সালের অর্ধবার্ষিকী প্রতিবেদনের হিসাব মতে, দেশের ২৩টি জেলা থেকে প্রায় ১৭ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। যার বেশিরভাগই ঘটেছে বিভিন্ন উপকূলীয় জেলাগুলোতে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে প্রায় দেড় কোটি। এছাড়াও প্রায় দুই কোটি শিশুর জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানবপাচারের মতো ঘটনা বাড়ার শঙ্কাও রয়েছে বলে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা ‘ডব্লিউএমও’-এর তথ্য অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছর এ যাবৎকালের সবচেয়ে উষ্ণ সময় পার করতে পারে বিশ্ব।
--সচেতনতা জরুরি-- পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন, এল নিনো ও লা নিনা স্বাভাবিক বিষয় হলেও মানুষের অবিবেচক কর্মকাণ্ড পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে অতিরিক্ত গাছ কেটে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে, জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুকে দূষিত করছে। আর অতিরিক্ত পরিমাণে যানবাহন ও কলকারখানাসহ কার্বন নিঃসরণকারী কার্যক্রমকে বৃদ্ধি করছে। এসবের ফলে পৃথিবীতে জীবনধারণ অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ছে। তাই আমরা যদি একটি বাসযোগ্য গ্রহ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে উপহার দিতে চাই, তবে অবিলম্বে আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন