আর্মেনিয়ান গির্জা: পুরান ঢাকার এক ঔপনিবেশিক স্মৃতি

আর্মেনিয়ান গির্জা: পুরান ঢাকার এক ঔপনিবেশিক স্মৃতি

আর্মেনিয়ান চার্চ, ১৭৮১। ঢাকায় বসবাসরত আর্মেনীয়দের মৃত্য হলে এখানে কবর দেয়া হতো। অন্য সব গির্জা থেকে  সম্পূর্ণ ভিন্ন এই আর্মানিয় গির্জা। এই গির্জার আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য সমাধিসৌধ। ১৭৮১ সালে নির্মিত চার্চটি ঢাকায় আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। অন্য সব ক্যাথলিক/ব্যাপ্টিস্ট চার্চ থেকে এই চার্চটি সম্পূর্ণ আলাদা। এখনও আর্মেনীয়দের অবশিষ্ট বংশধর এই চার্চের রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
ঐতিহ্যবাহী এই চার্চের সাথে জড়িয়ে আছে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ইতিহাস। আনুমানিক সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে দুই একজন করে আর্মেনীয় বনিক ঢাকায় আশা শুরু করে। ধারনা করা হয় তাদের নাম অনুসারে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার নামকরণ করা হয়। ৭০০ ফুট লম্বা গির্জাটির রয়েছে ৪টি দরজা আর ২৭টি জানালা। ভেতরে সারি সারি চেয়ার সাজানো রয়েছে আর রয়েছে পাদ্রি বসার জন্য একটি বেদি। 

আর্মেনীটোলায় থিতু হয়ে বসার পর আর্মেনীরা এখানে তাঁদের এই গীর্জা নির্মাণ করেন। মৃত্যুর পর ঢাকার আর্মেনীদের কবর দেয়া হয় আর্মেনী গীর্জার চতুর্দিকের প্রাঙ্গণের পরিসর ছোট হওয়ার কারণেই হয়তো গীর্জাটির গোটা প্রাঙ্গণ এমনকি বারান্দার মেঝেতেও প্রচুর সমাধিফলক চোখে পড়ে। অধিকাংশ এপিটাফ বা স্মৃতিফলকে উদ্ধৃত রয়েছে ধর্মগ্রন্থের বাণী।  এছাড়া জনৈক ক্যাটচিক আভেটিক থমাসের সমাধির ওপর তাঁর স্ত্রী কলকাতা থেকে কিনে এনে বসিয়েছিলেন সুন্দর এক মূর্তি, যা এখনো টিকে আছে। এপিটাফে তিনি তার স্বামীকে উল্লেখ করেছিলেন ‘বেস্ট অব হাজব্যান্ডস’ বলে।
গির্জার আশেপাশে রয়েছে প্রায় শ’’খানেক আর্মেনিয়ানের কবর। গির্জাটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। সারা বছরই তালা মারা থাকে। অনুমতি সাপেক্ষে ভিতরে প্রবেশ করা যায়।

উল্লেখ্য যে, আর্মেনীয়রা ব্যবসার উদ্দেশে আঠারো শতকের দিকে ঢাকায় আসতে শুরু করে। লবণ-চামড়া-কাপড় আর পাটের ব্যবসা করে আর জমিদারি কিনে অল্প সময়েই তারা ঢাকার একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী হয়ে ওঠে। যে অঞ্চলে আর্মেনীয়রা বসবাস করতে শুরু করে তার নাম হয়ে যায় আর্মানিটোলা। তারপর কোম্পানি আমলের শেষ দিকে এসে ব্যবসা পড়তে শুরু করে। আর পাকিস্তান আমলে ঢাকায় আর্মেনীয়দের বাস প্রায় উঠে যায়। ১৯৯১ সালে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা নেফিয়েট স্টেফানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঢাকার সঙ্গে আর্মেনীয়দের সম্পর্কের শেষ সূত্রটিও হারিয়ে যায়।

ঐতিহ্যবাহী এই গীর্জার সাথে জড়িয়ে আছে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ইতিহাস। গীর্জা নির্মাণের জন্য গোরস্থানের আশেপাশে যে বিস্তৃত জমি তা দান করেছিলেন আগা মিনাস ক্যাটচিক নামের এক আর্মেনীয়। আর লোকশ্রুতি অনুযায়ী গীর্জাটি নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন চারজন আর্মেনীয়। এরা হলেন মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটা সেতুর সিভর্গ, আগা এমনিয়াস এবং মার্কার পোগজ। গীর্জাটি লম্বায় সাড়ে সাতশো ফুট, দরজা চারটি, জানালা সাতটি।

এর পাশেই ছিলো একটি ঘড়িঘর। এটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন জোহানস কারু পিয়েত সার্কিস। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ঘড়িঘরটি ভেঙে গিয়েছিলো বলে জানা যায়। গীর্জায় বৃহৎ আকারের একটি ঘণ্টা ছিলো। এই ঘণ্টা বাজার শব্দ নগরের প্রায় সব স্থান থেকে শুনা যেত বলে সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই ঘণ্টার শব্দ শুনেই নাকি অধিকাংশ ঢাকাবাসী নিজ নিজ সময়ঘড়ি ঠিক করে নিতেন। ১৮৮০ সালের দিকে আর্মেনী গীর্জার এই বিখ্যাত ঘণ্টাটি স্তব্ধ হয়ে যায়, যা আর কখনো বাজেনি।

উনিশ শতকের ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে যে কয়েকটি আর্মেনীয় পরিবারের নাম পাওয়া যায় সেগুলো হলো- পোগস, আরাতুন, পানিয়াটি, স্টিফান, লুকাস, কোজা মাইকেল, মানুক, হার্নি, সিরকোর এবং সার্কিস। এদের বিত্তের ভিত্তি ছিলো জমিদারি ও ব্যবসা। বিদেশি হয়েও জমিদারি কেনার কারণ হতে পারে- আভিজাত্য অর্জন এবং সমাজের শীর্ষে থাকা। এসব ধনী আর্মেনীয়নরা ঢাকায় নিজেদের থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন প্রাসাদতুল্য সব বাড়ি।

১৮৫৬ সালে সিরকোরই ঢাকায় প্রথম ঘোড়ার গাড়ি চালু করেন, যা পরিচিত ছিলো ‘ঠিকা গাড়ি’ নামে। কিছুদিনের মধ্যেই এই ব্যবসা বেশ জমে উঠে এবং কালক্রমে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ঢাকার প্রধান যানবাহন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আর্মেনীয়দের অনেকের জমিদারি হাতছাড়া হতে থাকে। এমনিতে আর্মেনীয়রা খুব রক্ষণশীল, কিন্তু ঐ সময় চলছিলো একটি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। এরা তখন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং অনেকে জমিদারি বিক্রি করে ব্যবসার জন্য কলকাতায় চলে যান।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password