কোনটা আসল ‘আপনি’?

কোনটা আসল ‘আপনি’?
MostPlay

ভার্চুয়াল জীবন vs বাস্তব জীবন

-ইস, কি স্লিম! আর আমি! একটা ধুমসি!

হাহ! কী কপাল! এই বয়সেই পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে কত খ্যাতি! আর আমি! বসে বসে ঘাস কাটছি!

-বাহ সুন্দর তো ছবিটা! দুইটা লাইক পেয়েছে! আমি কি দিব? দরকার আছে? আমাকে কি ও লাইক দিয়েছে কখনো?

-আরে ঈষিতার বিয়ে ঠিক হয়েছে! কবে দেখি তো! মেয়েটা যা অহংকারী! দাওয়াত দিবে তো!

পাঠক, এ কথাগুলো আজকাল হয়তো আমরা প্রতিদিনই বলি। তবে জোরে জোরে নয়। মনে মনে। কখন বলুন তো? ঠিক ধরেছেন! ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম বা স্ন্যাপচ্যাটের মতো তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন নিজের পেজ স্ক্রল করি! কেন বলতে পারেন? কারণ ‘সোশাল’ বানানোর নামে এসব মিডিয়া আসলে ঈর্ষাকাতর, স্বার্থপর আর সেলফি-আসক্ত অসুখী মানুষেই পরিণত করছে আমাদের! বিশ্বাস হচ্ছে না? চলুন আরেকটু বুঝিয়ে বলি-

কোনটা আসল ‘আপনি’?

ফেসবুকে বা ইনস্টাগ্রামে নিজের যেসব ছবি আপনি পোস্ট করেন, তার কতটা আপনার বাস্তব জীবনের চিত্র?

আপনি কি সবসময়ই এমন সেজেগুজে থাকেন?

ঘরটাকে কি প্রতিদিনই এত গুছিয়ে রাখেন?

না কি প্রতিদিনই আপনি বুফে-তে যান?

ব্যাংকক-মালয়েশিয়ায়ই বা আপনি ক’বার গেছেন?

হয়তো একবারই। তো গেন্টিং আইল্যান্ডের কেবল কারে একবার মাত্র চড়ার যতগুলো ছবি আপনার ফেসবুকে আছে, সেটার পাশে প্রতিদিন যে আপনি লোকাল বাসে ঝুলে ঝুলে অফিসে যান, তার কয়টা ছবি আছে? একটিও না। কারণ ওটার ছবি আমরা কাউকে দেখাতে চাই না। অথচ কি জানেন, কারো ওরকম ছবি দেখেই হয়তো নিজের অজান্তেই আপনি নিজেকে তার সাথে তুলনা করছেন। হতাশ হচ্ছেন, বিষণ্নতায় ভুগছেন, এমনকি হয়ে উঠছেন ঈর্ষাকাতর!  

কার জন্যে ‘আপনি’?

ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে ছবি পোস্ট করার পর ‘লাইক’ না পেয়ে মন খারাপ হয় নি, এমন কাউকেই বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি যতটা ‘লাইক’ পাবেন বলে ভেবেছিলেন, ততটা না পেয়ে ফেসবুক থেকে ছবি সরিয়ে ফেলেছেন- এমন ঘটনার কথাও আপনি নিশ্চয়ই জানেন। কিংবা একটু পর পরই ঢুকে ‘নোটিফিকেশন’ চেক করছে বা ‘লাইক’ গুনছে এ মানুষরাও হয়তো আপনার আশপাশেই আছে!

আচ্ছা বলুন তো- “এই সেলফিটা এক্ষুণিই তুলতে হবে, তা নইলেই শেষ”- এত তাড়া কেন এখন আমাদের! বা বেস্ট সেলফিটা পাওয়ার জন্যে কমসে কম ৩০০ সেলফি - এমন পাগলামিও কি এর আগে কখনো ছিল আমাদের?

এ সবকিছু একটা ইঙ্গিতই করে! সোশাল মিডিয়ায় একটিভ হতে গিয়ে আমাদের গুরুত্ব, কাজের মূল্যায়নের ভার নিজের অজান্তেই আমরা তুলে দিচ্ছি ‘লাইক’, ‘শেয়ার’ আর ‘কমেন্ট’ এর হাতে। ফলোয়ার কত বাড়লো তা দিয়েই বিচার করছি নিজের মর্যাদাকে, মহত্ত্বকে। 

আপনি কী হারাবেন?

ফেসবুকে না থাকলে আমি তো আপডেটেড থাকতে পারব না! বন্ধুদের সাথে আমার যোগাযোগ কীভাবে হবে! দেশের খবর, বিশ্বের খবর, দৈব দুর্বিপাকের খবর বা রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ- এসবই বা পাব কীভাবে!- এই ভাবনাগুলো আমাদের অনেককেই ভয় পাইয়ে দেয়।

একটু ভাবুন তো, সোশাল মিডিয়ায় থেকে আসলে কি আমাদের বন্ধু বেড়েছে? ২০০১ সালে গ্যালাপের একটা জরিপ হয়েছিল মার্কিনীদের নিয়ে। সেসময় গড়পড়তা একজন আমেরিকানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সংখ্যা ছিল ১০ জন। কিন্তু ২০১৪ সালে যখন সেই একই জরিপ আবারো করা হলো, দেখা গেল সংখ্যাটা নেমে এসেছে মাত্র দুইয়ে! অর্থাৎ মন খুলে কথা বলা যায়, বিপদ-আপদে পাশে পাওয়া যায় – সত্যিকারভাবেই এমন বন্ধু বলতে গড়পড়তা একজন আমেরিকান এখন দুজনের বেশি কাউকে পাচ্ছে না! তাহলে? ফেসবুকের ঐ হাজার হাজার ফ্রেন্ড বা ফলোয়াররা সব গেল কোথায়?

চেনেন কি এদের?

সোশাল মিডিয়ার ফ্রেন্ডরা আসলে কারা? আপনি কি আদৌ এদের চেনেন? দু’চারটা হাইলি এডিটেট ছবি দেখে আর ঠুনকো ‘লাইক’ পেয়ে যাদের ‘বন্ধু’ ভাবছেন, তাদের বাস্তব জীবন সম্পর্কে কতটুকু জানেন আপনি? কিংবা ফেসবুকের কল্যাণে বহু বছরের পুরনো পরিচিতকে খুঁজে পেয়েছেন ভেবে যতটা উল্লসিত হয়ে উঠছেন, সত্যিই কি অত উল্লসিত হবার কিছু আছে? যোগাযোগ তো সেই ফেসবুকের পেজেই সীমিত!

অথচ এই ‘বায়বীয় বন্ধু’দের জন্যেই হয়তো দিনের পর দিন আপনি অগ্রাহ্য করছেন আপনার সেই প্রিয়জনদের যারা আপনাকে ভালবাসে। গভীর মমতায় যারা সেবা করে আপনার অসুস্থতায়। নিঃশর্ত সমর্থন নিয়ে পাশে দাঁড়ায় আপনার সকল বিপদে।  

জাহাজের খবর দিয়ে কী করবেন?

এ কথা ঠিক যে সোশাল মিডিয়ার কারণে আপনি এখন দেশের খবর, বিশ্বের খবর, দৈব দুর্বিপাক বা রাজনীতির খবর এক নিমিষেই পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ভেবে বলুন তো, এসব খবর আপনি কেন চাচ্ছেন? আপনি কি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত শিশুদের সাহায্য করবেন? না ফ্লোরিডার স্কুলে গোলাগুলির ঘটনায় আপনার করার আছে কিছু? কিছুই করার নেই। আপনি বড়জোর যা করবেন তাহলো নিরর্থক কিছু আলোচনা, সমালোচনা যাতে কারো কিছু এসে যায় না! তাছাড়া বিশেষ প্রোপাগান্ডা নিয়ে যারা খবর ছড়াচ্ছে, তাদের মিথ্যা মেশানো খবর থেকে সত্যকে আলাদা করা- আর যেই হোক, আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশ্বাস করুন সোশাল মিডিয়া ছেড়ে দিয়ে আপনি গুজব, গালগল্প, হালকা রসিকতা বা আজগুবি খবর- ছাড়া আর বেশি কিছু আপনি হারাবেন না!


যেমন পেয়েছেন মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড. ক্যাল নিউপোর্ট। মার্ক জাকারবার্গের ‘ফেসবুক’ যখন মাত্র হার্ভার্ডের গণ্ডী পেরিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়াচ্ছে, সেসময় অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়া নিউপোর্ট অনেকটা অভিমানের বশেই সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি ফেসবুক ব্যবহার করবেন না। আসলে সেসময় নিজের একটা ব্যবসা শুরু করেছিলেন নিউপোর্ট। কিন্তু লোকসানের শিকার হওয়ায় ব্যবসাটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। ওদিকে ফেসবুক দিয়ে মার্ক জাকারবার্গের অব্যহত সাফল্য তাকে কিছুটা শিশুসুলভ ঈর্ষায় আক্রান্ত করে এবং তখন থেকেই ঠিক করেন যে যত যাই হোক, এটা তিনি ব্যবহার করছেন না। একযুগ পর আজ পেছন ফিরে তাকিয়ে ড. নিউপোর্ট সেদিনের সেই বালকসুলভ পদক্ষেপকে আখ্যা দেন তার জীবনের সবচেয়ে সঠিক ও নিরাপদ সিদ্ধান্ত বলে।

ড. নিউপোর্ট আজ একজন সফল বিজ্ঞানী। একজন অধ্যাপক। এ বয়সেই পাঁচ পাঁচটি বেস্ট সেলার বইয়ের লেখক। তার সাবজেক্টে তিনি এমন একজন এক্সপার্ট যে এর ওপর বক্তৃতা দেয়ার জন্যে প্রায়ই তাকে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা তো বটেই, দেশের বাইরেও ঘুরে বেড়াতে হয় বিভিন্ন সময়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব কাজ যে তিনি রাত-দিন দম বন্ধ ব্যস্ততায় বসে করছেন, তা কিন্তু না। ড. নিউপোর্ট বলেন, খুব কম দিনই আছে যেদিন তাকে বিকাল পাঁচটার পরও অফিস করতে হয়। তার মানে, সাধারণভাবে প্রতিটি মানুষের যে পরিমাণ কর্মঘণ্টা, সেই ৮ ঘণ্টা কাজ করেই তিনি এ সাফল্য পাচ্ছেন। কারণ সোশাল মিডিয়াজনিত বিক্ষিপ্ততা না থাকার ফলে সেই ৮ ঘণ্টাই হচ্ছে অখণ্ড মনোযোগের ৮ ঘণ্টা। এবং তিনি খুব প্রশান্ত জীবনযাপন করেন। টিভি তিনি দেখেন না। তবে রেডিওতে বেসবল খেলা শোনেন। বাসায় ফিরে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাবার পর তাদেরকে ঘুমোতে পাঠিয়ে তিনি বসেন বই নিয়ে। পাঠক, বলা বাহুল্য, এ বই কিন্তু পিডিএফ বই না, হার্ড কভার বই!

শুধু ড. নিউপোর্টই নন। একসময় যারা ফেসবুকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছেন, তারাও আজ অনুশোচনায় দগ্ধ। নিজেরা যেমন মুক্ত হয়েছেন, তেমনি ডাক দিচ্ছেন তরুণপ্রজন্মকে।

চামাথ পালিহাপিতিয়া। ফেসবুকের সাবেক নির্বাহী, আজকের ফেসবুকের ব্যবহারকারী সংখ্যা বাড়ানোর মূল দায়িত্বে যিনি ছিলেন সেই শুরু থেকেই। কিন্তু একসময় ছেড়ে দিয়েছেন মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে। এখন ফেসবুক ব্যবহার করেন না। তিনি বলেন, “এসব সোশাল নেটওয়ার্ক আমাদের সমাজের কার্যকারণকে নষ্ট করে দিচ্ছে। মানুষের মাঝে আজকের যে অসহযোগিতা, যে অপতথ্য, মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়ি, যে অস্থিরতা- এর মূল কারকই হলো এসব সোশাল মিডিয়া। এবং এটা শুধু মার্কিনীদের সমস্যা নয়, এটা শুধু রাশিয়ান সমস্যা নয়, এটা এখন পুরো বিশ্বের সমস্যা। আর সমাধান যদি জানতে চান, তো আমি বলব, সেটা একটাই। আর তাহলো এটা ব্যবহার না করে। যেমন আমি করি না। আপনি যদি আমার ফেসবুক একাউন্টে ঢোকেন তো দেখবেন গত ৭ বছরে আমি মাত্র ২/৩ বার হয়তো এখানে পোস্ট করেছি। কারণ আমি মনে করি, এটা আমাদের সমাজকে, সমাজের ভিতকে খুব ন্যাক্কারজনকভাবে ক্ষইয়ে দিচ্ছে।

তাহলে এবার সিদ্ধান্ত আপনার। সুখী হবেন, না দুশ্চিন্তা, হতাশা বিষণ্নতার অন্তহীন দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাবেন.....

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password