দেশে একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ বছরের রেকর্ড মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা পার করল বাংলাদেশ। এ সময়ের মধ্যে সরকারি হিসাবে ৮৩৬ রোগী ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বেসরকারি হিসাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক মাস ধরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। একদিনে যে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে ৫ জনই নারী। এর মধ্যে ঢাকায় ২ জন, কুমিল্লায় ২ জন, বরিশাল ও রাজশাহীতে একজন করে মারা যান। তাদের বয়স ২২ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। একদিনে এত মৃত্যু সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বমুখী ধারায় উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রোববার সবাইকে বলেছেন, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু আরও বাড়তে পারে। এজন্য সবাইকে সতর্ক হতে হবে। এডিস মশা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দেশে কীভাবে ডেঙ্গু এত বিপজ্জনক হয়ে উঠল তা জানতে একটু পেছনের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। ২০০০ সালে সর্বপ্রথম দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বড় আকারে দেখা দেয়। তখন সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক ও সরকার এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। সেই থেকে নিয়মিতভাবে বর্ষা মৌসুম এলেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এরপর থেকে প্রায় দুই যুগ পার হতে চলছে। কিন্তু ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করছে না।
এর ফলে তারা এক অর্থে ব্যর্থতার পরিচয়ই দিয়েছে। স্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, দেশ স্বাধীনের আগে ১৯৬৫ সালে প্রথম ডেঙ্গু আসে। তখন চিকিৎসকরা এটি যে মশাবাহিত রোগ বুঝতে পারেননি। সেটা ‘ঢাকা ফিভার’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একাধিক টিম বাইরের দেশে রোগটি নিয়ে গবেষণা করে।
১৯৭০ সালে এডিসি ইঞ্জিন্টি নামের এডিস মশার প্রজাতি থেকে ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর দেশে ২০২০ সালে রোগটির প্রাদুর্ভাব বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ে। রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) যুগান্তরকে জানিয়েছে, ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ৯৩ জন মারা যান। এরপর ২০০১ সালে ২,৪৩০ জন আক্রান্ত ও ৪৪ জনের মৃত্যু হয়।
২০০২ সালে ৬,২৩২ আক্রান্ত ও ৫৮ জনের মৃত্যু, ২০০৩ সালে আক্রান্ত ৪৮৬ ও ১০ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৪ সালে ৩,৪৩৪ জন আক্রান্ত ও ১৩ জনের মৃত্যু হয়, ২০০৫ সালে ১,০৪৮ জন আক্রান্ত ও ৪ জনের মৃত্যু হয়, ২০০৬ সালে ২,২০০ জন আক্রান্ত, ১১ জনের মৃত্যু হয়, ২০০৭ সালে ৪৬৮ জন, ২০০৮ সালে ১,১৫৩ জন, ২০০৯ সালে ৪৭৪ জন, ২০১০ সালে ৪০৯ জন আক্রান্ত হন। তবে এই তিন বছর ডেঙ্গুতে কেউ মারা যায়নি।
এরপর ২০১১ সালে আক্রান্ত হন ১,৩৫৯ জন, মারা যান ৬ জন, ২০১২ সালে আক্রান্ত ৭৬১ ও একজন মারা যান, ২০১৩ সালে আক্রান্ত ১,৭৭৯ জন, মৃত্যু হয় ২ জনের, ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন আক্রান্ত হলেও কেউ মারা যায়নি। ২০১৫ সালে আক্রান্ত হন ৩,১৬২ জন, মারা যান ৬ জন, ২০১৬ সালে আক্রান্ত হন ৬,০৬০ জন, মারা যান ১৪ জন, ২০১৭ সালে আক্রান্ত হন ২,৭৬৯ জন এবং মারা যান ৮৮ জন, ২০১৮ সালে আক্রান্ত হন ১০,১৪৮ জন, মারা যান ২৬, ২০১৯ সালে আক্রান্ত হন ১,০১,৩৫৪ জন, মারা যান ১৭৯ জন, ২০২০ সালে আক্রান্ত ১,৪০৫ জন, মারা যান ৭ জন, ২০২১ সালে আক্রান্ত হন ২৮,৪২৯ জন, মারা যান ১০৫ জন। এরপর গত বছর ২০২২ সালে আক্রান্ত হন ৪৪৮২ জন এবং ১৮২ জন মারা যান।
এরপর চলতি বছরে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২ হাজার ৯৪৫ জন এবং ৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ২০০০ সালের পর থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সমস্যা সমাধান করতে কাজ করছে। কিন্তু তাদের কাজে কোনো সমন্বয় নেই। এই পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু এখন সারা দেশের রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত বছর ৫০টির বেশি জেলায় ছড়িয়েছিল। এ বছর ৫৭টি জেলায় ছড়িয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ব গবেষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, বৃষ্টিপাত বাড়লে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ে। সবার আগে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। স্বল্প সময়ের অভিযান বা কার্যক্রম করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে পাঁচ থেকে ১০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বছরব্যাপী চলমান থাকতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মহাপরিকল্পনায় সমন্বিত মশা ব্যবস্থাপনা বা ইন্টিগ্রেটেড মসকিউটো ম্যানেজমেন্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার চারটি মূল স্তম্ভকে একসঙ্গে সারা বছর বাস্তবায়ন করতে হবে।
তবে মশাবাহিত রোগ, যেমন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মশা নিধন ও ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেন, ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কে কে কৃষ্ণমূর্তি সরকারকে ২২ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। তাতে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে করণীয় বলা ছিল। পাশাপাশি ২০টির বেশি সুপারিশ ছিল।
১২টি মন্ত্রণালয়ের পৃথকভাবে সুনির্দিষ্ট করণীয় তাতে উল্লেখ ছিল। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে গণমাধ্যমকে কীভাবে যুক্ত বা ব্যবহার করতে হবে, সেই পরামর্শও তাতে ছিল। তখন সুপারিশ বা পরামর্শ ২০১৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। সরকার সেই উদ্যোগ নেয়নি। দুই বছর পর ২০১৯ সালে ওই সংস্থার জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ বিএন নাগপাল ডেঙ্গুর জীবাণুবাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সুনির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। সরকার সেই পরামর্শও সব শোনেনি।
রাজধানীর দুই সিটির চিত্র : কীটত্ত্ববিদরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণকাজের সঙ্গে পেশাজীবী কীটতত্ত্ববিদ সম্পৃক্ততা জরুরি। কিন্তু ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কাজের সাতজন এমবিবিএস চিকিৎসক নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সঙ্গে রয়েছে ১ হাজার ৫০ জন মশককর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক। নেই নিজস্ব গবেষণাগার। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
একজন কীটতত্ত্ববিদ ও ১৩ জন এমবিবিএস পাশ করা চিকিৎসক দিয়ে এই টিমকে সহায়তা দিচ্ছে প্রায় ৮০০ জন মশককর্মী। তাদেরও নেই নিজস্ব গবেষণাগার। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে সামছুল কবির বলেন, ডেঙ্গুর স্টেকহোল্ডার শুধু সিটি করপোরেশন নয়; বরং দেশের ১৬ কোটি মানুষ। সমাধান করতে হলে সমস্যার গভীরে যেতে হবে।
এডিস মশা জন্মায় মানুষের বাড়িঘরে। কাজেই জনসচেতনতা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আমরা দিনরাত চেষ্টা করছি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে ডেঙ্গু ক্রমাগত রূপ পালটাচ্ছে। দ্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ণে মশার বংশবিস্তার বাড়ছে, সঙ্গে মানুষের অসচেতনতায় মশা নিধন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচারক (প্রশাসন) ডা. রাশিদা সুলতানা বলেন, সারা দেশের চিকিৎসকদের অনলাইনে ডেঙ্গু চিকিৎসা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসকদের ঢাকায় এনেও প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন-মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করছে। আমাদের সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ডেঙ্গুতে ছয় মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৩৬ : এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে আরও ৮৩৬ রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
একই সময়ে ডেঙ্গুতে আরও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন ভর্তি রোগীর ৫১৬ জন ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৩২০ জন ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে দেশে সর্বমোট ছাড়প্রাপ্ত ডেঙ্গুরোগী ১০ হাজার ১৩১ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত রোগী ৭ হাজার ৬৬ জন এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে ৩ হাজার ৬৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে এবং এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন