কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসাবে সমধিক পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সৈনিক,সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সংগীত জগৎকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।
প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। নজরুলের কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তার লেখনী জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তাকে দেওয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি দেয়। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি একুশে পদকে ভূষিত হন কবি।
উপনিবেশিত ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন নজরুল। ঔপনিবেশিক শাসন-শৃঙ্খলের নানামুখী প্রতিক্রিয়া আলোড়িত করেছিল কবিকে। তাঁর উজ্জীবনী বাণীকণ্ঠ ওই শৃঙ্খল-মোচনের বরাভয় বাণীরূপে গৃহীত হয়েছিল গণকণ্ঠে। আশ্চর্য হলেও সত্য, ভারতীয় স্বাদেশিকতার বিশাল পরিসর থেকেই মাতৃভূমি বাংলার গৃহকোণ, মায়ের মাটি আর সজল-শ্যামল আটপৌরে রূপমাধুরী আকৃষ্ট করেছিল কবিকে। ফলে ভারতীয় জাতীয়তার জাগরণের মধ্যেই বাংলার স্বকীয়তা ও আনন্দময় গড়নশোভায় বিশ্বজননীর আঁচলপাতা হরিৎক্ষেত্র উদ্দীপ্ত করেছিল । নজরুল 'জয় বাঙলা'র উদ্দীপনা বিস্তারী জয়ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিলেন দেশবন্দনায়।
বাংলা সাহিত্যের নানা যুগের স্তরে স্তরে স্বদেশ-বন্দনা কীর্তিত হয়েছে, তবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র-কাঠামোয় দেশপ্রেম বলতে যা বোঝায়, তা যে পরাধীন জাতিসত্তার দেশচেতনারই উপলব্ধি কিংবা অভিব্যক্তি, বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এ-কথাও বলতে বাধা থাকে না যে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বাংলায় আধুনিক দেশচেতনার স্ফুরণ আর বিশ শতকের ঊষাকাল থেকে ওই চেতনাই নানা টানাপোড়েন ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে দেশপ্রেমে পর্যবসিত হয়েছে। ওই ঊষাকালে খণ্ড-অখণ্ড বাংলা নিয়ে রাজনীতির জগৎ ঘোলা হয়েছে বিস্তর, সশস্ত্র ত্রাস ও নরমপন্থী রাজনীতির ডামাডোলে উত্তপ্ত হয়েছে- জনজীবন। আর ওই রাজনৈতিক সূত্রকে উপলক্ষ করেই যে ক্রমান্বয়ে স্ফটিকায়িত হওয়ার সুযোগ ঘটেছে বাঙালির দেশপ্রেমের, এ-কথাও তো অসত্য নয়।
নজরুলের সাহিত্যবিশ্বেও 'বাঙলা' বা 'বাঙলাদেশ' মাতৃকল্পরূপিণী। বিশ শতকের তৃতীয় দশকের সূচনাপর্বে উপনিবেশিত ভারতে যখন রাজনীতি-সংসক্ত দেশচেতনা স্ফটিকায়িত হয়ে উঠেছে, সাহিত্যের ভুবনে নজরুলের অভ্যুদয় তার সমসময়-লগ্ন। দ্বিধার দোলাচল তখন লুপ্ত হয়ে গেছে, সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক শক্তির জালিমি বিকার আর সশস্ত্র হুংকার। সম্প্রদায়ের ঘেরাটোপ বন্ধন হয়ত-বা প্রতিবন্ধক ছিল চলায়, কিন্তু অবলীলায় নজরুল টপকে গিয়েছিলেন ওই বাধা। এক ইতিবাচক রাজনৈতিক দেশচেতনায় পরিশ্রুত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই ভারতবর্ষীয় রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেই খুঁজে নিয়েছিলেন মাতৃসংস্কৃতি-ভূমির মানচিত্র। ফলে 'জয় বাঙলা' বিজয়ধ্বনিতে দেশমাতৃকা 'বাঙলাদেশ'-বন্দনায় নজরুল হয়ে উঠেছিলেন কুণ্ঠাহীন কবি-ঋত্বিক। 'জয় বাঙলা' পদবন্ধে জয়ধ্বনি দিয়ে দেশমাতৃকার পরিচয়-জ্ঞাপক তূর্যবাদনে নজরুলই সম্ভবত পালন করেছিলেন পথিকৃতের ভূমিকা। নজরুলের ভাঙার গান (শ্রাবণ ১৩৩১) প্রকাশের পর বঙ্গীয় সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল গ্রন্থটি। প্রিন্স অব ওয়েলস্-এর ভারত-ভ্রমণ উপলক্ষে কংগ্রেস ঘোষিত হরতাল এবং অহিংস- অসহযোগ আন্দোলনসহ সমসাময়িক নানা তপ্ত ঘটনার সমর্থনে ও প্রতিক্রিয়ায় গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো লিখিত ও সাময়িকপত্রসমূহে প্রকাশিত হয়েছিল। 'পূর্ণ- অভিনন্দন' তেমনি এক সাময়িক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় লেখা সম্ভাষণ-কবিতা। অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাস ছিলেন পূর্ব বাংলার মাদারীপুরের শান্তি-সেনা বাহিনীর প্রধান। ইতঃপূর্বে কয়েকবার রাজ-সরকার কারারুদ্ধ করেছিল তাঁকে। তাঁরই কারামুক্তি উপলক্ষে উদ্দীপনাবিস্তারী এই সম্ভাষণ-কবিতা লিখেছিলেন নজরুল ইসলাম। ছয়- পঙ্ক্তিযুক্ত নয়টি স্তবকে বিন্যস্ত নাতিদীর্ঘ এই কবিতায় ধ্রুবপদ-রূপে স্তবক-শেষে নয়বার ব্যবহৃত হয়েছে 'বাঙলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা- ভাগীরথীর।'-এই উদ্দীপক পঙক্তিটি।
ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব-গৃহকোণ 'বাঙলা', নজরুল-সম্ভাষণেও মাতৃ-অভিধায় সুচিহ্নিত। সমকালীন ব্রিটিশ-ভারতীয় রাজনীতির অভ্যন্তর থেকেই উদ্ভিন্ন হয়েছিল এই রাজনৈতিক দেশচেতনা। দলীয় রাজনীতির সাংগঠনিক শৃঙ্খলার সঙ্গে নিজেকে না জড়ালেও, নজরুল ছিলেন রাজনৈতিক সময়ের মানুষ, বিভিন্নমুখী রাজনৈতিক সংশ্রব মুখর করেছিল তাঁর জীবন। ফলে স্বকীয় এক রাজনৈতিক চেতনায় নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। বয়োজ্যেষ্ঠ মুজফ্ফর আহমদের বন্ধুসান্নিধ্য পেয়েও দীক্ষিত কমিউনিস্ট হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি নজরুলের, এমনটি তাঁর প্রার্থিত ছিল না, স্বভাবধর্মেরও অনুকূল ছিল না। অথচ স্বনিরূপিত মূল্যবোধকে প্রতিমান্বিত করে তিনি রচনা করে ফেললেন সাম্যবাদী (১৯২৫) ও সর্বহারার (১৩৩৩) অসামান্য কবিতাগুচ্ছ। চেতনবিশ্বে সৃজন করে নিলেন জন্মভূমি বা স্বদেশের মাতৃমূর্তি। বিভিন্ন সময়ে লেখা নানা কবিতায় রূপান্বিত হলো ওই মাতৃপ্রতিমা।কবির সৃজনসামর্থ্য নিঃশেষিত হওয়ার কয়েক মাস আগে ২ জুন, ১৯৪২ দৈনিক 'নবযুগ' পত্রিকার 'আমার সুন্দর' শীর্ষক সম্পাদকীয় রচনায় নজরুল তাঁর দেশচেতনা সংগঠিত হওয়ার স্মৃতিচুম্বক গ্রথিত করে লিখেছিলেন:
'জেলে আমার সুন্দর শৃঙ্খলের কঠিন মালা পরিয়েছিলেন হাতে-পায়ে; জেল থেকে বেরিয়ে এলেই আমার অন্তরতম সুন্দরকে সারা বাঙলাদেশ দিয়েছিল ফুলের শৃঙ্খল, ভালোবাসার চন্দন, আত্মীয়তার আকুলতা। আট বৎসর ধরে বাঙলা-দেশের প্রায় প্রতি জেলায়, প্রতি মহকুমায়, ছোট বড় গ্রামে ভ্রমণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে, কখনো কখনো বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালাম। এই প্রথম আমার মাতৃভূমি বাঙলাদেশকে ভালোবাসলাম। মনে হল, এই আমার মা। তাঁর শ্যাম-স্নিগ্ধ মমতায়, তাঁর গভীর স্নেহ-রসে, তাঁর উদার প্রশান্ত আকাশের কখনো ঘন, কখনো ফিরোজা-নীলে আমার দেহ-মন-প্রাণ শান্ত-উদার আনন্দ- ছন্দে ছন্দায়িত হয়ে উঠল। আমার অন্তরের সুন্দরের এই অপরূপ প্রকাশকে এই প্রথম দেখলাম প্রকাশ-সুন্দর রূপে, আমার জননী জন্মভূমিরূপে।'
-'বাঙলা দেশের' প্রতি এই ভালোবাসা ও মমতা নজরুলের বিভিন্ন পর্যায়ে লেখা গানে-কবিতায় মাতৃকল্প উপমা ও প্রতিমার আশ্রয়ে রূপমধুর হয়ে উঠেছে।
বাঙালি শুধু লাঠি দিয়েই দেড়শত বছর আগেও তার স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রাখতে চেষ্ট করেছে। আজো বাংলার ছেলেরা স্বাধীনতার জন্য যে আত্মদান করেছে, যে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, ইতিহাসে তা থাকবে স্বর্ণ-লিখায় লিখিত।... বাংলার আবহাওয়ায় আছে স্বাধীনতা-মন্ত্রের সঞ্জীবনী শক্তি। আমাদের বাংলা নিত্য মহিমাময়ী, নিতা সুন্দর,নিত্য পবিত্র।
আজ আমাদের আলস্যের, কর্ম-বিমুখতার পৌরুষের অভাবেই আমরা হয়ে আছি সকলের চেয়ে দীন।... বাঙালি
সৈনিক হতে পারল না। ক্ষাত্র শক্তিকে অবহেলা করলো বলে তার এই দুর্গতি
তার অভিশপ্তের জীবন।... বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এক মন্ত্র শেখাও:
"এই পবিত্র বাংলাদেশ-বাঙালির আমাদের।..."
বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙলার জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।
নজরুলের চেতনাবিশ্বে মাতৃস্বরূপে অধিষ্ঠান বাংলার। কবির গানে-কবিতায়-গল্যে মাতৃকল্প স্বদেশ নিজের আটপৌরে স্বভাব ও অনিঃশেষ সম্ভাবনা নিয়ে সুরময় ও চিত্ররূপময়। স্বদেশের অক্রমতী অবয়বের বিপরীতে 'সকল সহা' ও 'সঞ্জীবনী বাণী'র শক্তিতে শক্তিমতী এই মাতৃমূর্তি। 'জয় বাঙলা' সম্বোধন-দানির উদ্যোক্তা এই কবিকে, বাঙালির জাতিসত্তার রষ্ট্রিকাঠামো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ শ্রদ্ধা-সম্মান ও কৃতজ্ঞতায় তাঁর ঋণ স্বীকার করে নিয়েছে সেই সাথে তিনি জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন