ভ্রমণ সব সময় আনন্দময় ও স্মৃতিময় ;ভ্রমণের কথা মনে হলেই গভীর সুখ অনুভব হয়। দলবদ্ধ ভ্রমণ হলে তো কোনো কথাই নেই, সেই ভ্রমণ হয়ে ওঠে আরও প্রাণবন্ত। তবে ভ্রমণ দলবদ্ধ হোক বা একাকী, ভ্রমণ শুধু ক্লান্তি দূর করে না,অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়।
ভ্রমণ যে ক্লান্তি ও গ্লানিতে ভরে ওঠা মনকে আবারও কোনো এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সতেজ করে তোলে তার প্রমাণ পাওয়া যায় সফরসঙ্গীদের কাছ থেকে।
আর সেই ভ্রমণ যদি হয় সাদা পাথরের দেশে,যেখানে শুধু সাদা পাথরের রাজ্য,জল গড়িয়ে পড়ছে তৃষ্ণার্ত ধলাইয়ের মুখে। সাদা পাথরের গা ছুঁয়ে অবিরাম গড়িয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা স্বচ্ছ ঝর্ণার জল।যেখানে স্বচ্ছ জলে আনন্দে আত্মহারা সকল পর্যটক।
পর্যটন স্পটটিতে পৌঁছে বুঝলাম, মনকে সতেজ করে তুলতে চাইলে সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর থেকে ঘুরে আসতেই হবে।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তবর্তী ভোলাগঞ্জের ধলাই নদের উৎসমুখ জিরো পয়েন্টেই সাদা পাথর এলাকা অবস্থিত। প্রায় পাঁচ একর জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই সাদা পাথরের রাজত্ব।
‘সাদা পাথর’ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির পাশের একটি এলাকা। সীমান্তের শূন্য রেখার কাছে অবস্থান। এলাকাটি ‘সাদা পাথর’ পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি।
সবুজে মোড়ানো মেঘালয় পাহাড় ঘিরে রেখেছে মেঘ, পাদদেশ ছুঁয়ে বহমান স্বচ্ছ শীতল জলরাশি। উঁচু-নিচু ঢেউ এসে খেলছে ধলাই নদের বুকে।
ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, উঁচু পাহাড়। এপারে বাংলাদেশের সাদা পাথরের রাজ্য। উঁচু পাহাড় দেখে আনন্দ যেন থামছেই না, পাঁচ একর জমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এই সাদা পাথর। ছোট, মাঝারি, বড় আকৃতির পাথর। সাদার মধ্যে নিকষকালো পাথরও আছে। কোনোটি খয়েরি রঙের। যেন এলাকাজুড়ে পাথরের বিছানা।
পাথর মাড়িয়ে ঝরনার আবাহন। কোথাও হাঁটু সমান, আবার কোথাও কোমর পানি। কোথাও তারও অনেক বেশি। কোথাও কোথাও পানির রং খয়েরি, আবার পাশেই পাহাড় থেকে ঝরনার পানিতে চেহারা দেখা যায়। পর্যটকদের ওই ঝরনার পানিতে নেমে কেউ গোসল করছেন আবার কেউ কোমর সমান নেমে ছবি তুলছেন। জীবনকে খানিকটা চাঙা করতে অনেকেই সাঁতার কাটছেন ধলাইয়ের শীতল জলরাশিতে। এ এক অসাধারণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা! কী ঠান্ডা পানি, কী স্বচ্ছ! দেখে মনে হবে, ফিল্টারিং করা!
পাহাড়-পাথর-জল, পাহাড়ের ওপরে কালো আর সাদা মেঘ, নিচে সাদা পাথর আর ঝরনার পানি মাঝে মাঝে রূপ পরিবর্তন করে একসঙ্গে এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেখা পাওয়া গেছে শুধু সিলেটে। সেখানে যেন পাথরের সুবিশাল এক ‘বিছানা’ (শয্যা) পাতানো।
সেখানে রয়েছে প্রকৃতির এই রূপের আধাঁর। দেখলাম ধলাই নদে কম পানিতেই নৌকা চলছে। বালুপথ মাড়িয়ে সামনে এগোতেই চোখে পড়ে নিরেট পাথররাজ্য। পাথর ছুঁয়ে ধেয়ে নামছে মেঘালয় পাহাড়ের ঠান্ড ও স্বচ্ছ জলরাশি। বিশাল এলাকাজুড়ে দুদিকে নিরেট পাথররাজি আর মধ্যে স্বচ্ছ জল। সাদা পাথরে দাঁড়িয়ে দেখলাম ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের ওপর মেঘের আলিঙ্গন। এ যেন প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য। এ দৃশ্য দেখার পর মনে পড়লো বিশ্ব কবি রবীন্দ্রাথ ঠাকুরের সেই কবিতার কথা।তাইতো কবি লিখেছিলেন-
"বহুদিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে/দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শীষের উপরে, একটি শিশির বিন্দু...।"
আসলেও তাই। আমাদের ঘরের পাশে থাকা ভোলগঞ্জের সেই সাদা পাথরে অবহেলা করে আজও অনেকেই যাননি। আর সেখানে না গেলে সেই পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের আলিঙ্গণও দেখা হবেনা কখনও।
জানা গেছে, ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর পানির সঙ্গে প্রতিবছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। ধলাই নদীর তলদেশেও রয়েছে পাথরের বিপুল মজুদ। পাথর উত্তলোনের কাজ সহজ করতে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পযন্ত ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে রোপওয়ে টাওয়ারগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যদিও বর্তমানে বন্ধ কিন্তু সেখানে গেলেই চোখে পড়বে পাথর উত্তেলনের দৃশ্য। ছোট ছোট নৌকায় করে পাথর উত্তলোন করে বয়ে নেওয়ার দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারি ভোলাগঞ্জের উৎসমুখ সাদাপাথরে সবসময়ই চেরাপুঞ্জি থেকে স্বচ্ছ নীল ও ঠান্ডা পানি নেমে আসে।
এখানে এসে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ সাদা পাথরের বিছানা এলোমেলো হওয়াতে সতর্কতার সঙ্গে হাঁটাচলা করতে হবে, না হয় ঘটতে পারে যে কোনো দুর্ঘটনা।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন