চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর পৌরবাজার সংলগ্ন পূণর্ভবা নদীর মহন্ত ঘাটে মাটি খুঁড়লেই মিলছে মোগল ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের বিভিন্ন প্রকার ধাতব মুদ্রা। বিশেষ করে স্বর্ণ, রৌপ্য, চাদি ও তামার তৈরি সরঞ্জাম লৌহার টুকরা, পাথরসহ আসবাবত্রের বিভিন্ন ধরনের থালা বাসন বাটি ও চামুচ। আর তাই গুপ্তধনের আশায় স্থানীয় লোকজন কোদাল ও খুনতি নিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাটি খুঁড়ছে। অনেকে ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত দৈনিক আয় করছে। আবার কেউ স্বর্ণের সরঞ্জাম পেলে আরও বেশি আয় করছে। এসব সরঞ্জাম দেখতে প্রতিদিন পূণর্ভবা নদীর ওই ঘাটে ভিড় করছে উৎসুক জনতা। কেউ কেউ সরঞ্জামগুলো কিনতে যাচ্ছেন। গত কয়েকবছর যাবত এ দৃশ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, রহনপুর শহর প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধণ রাজ্যের জনপদ ও প্রাক মুসলিম যুগে উন্নত ইসলামী নগরী হিসেবে খ্যাত ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে এটি ভারতের বৃহত্তর মালদহ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহানন্দা পূণর্ভবা নদীর মিলনস্থানে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠে এ শহরটি। হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় ধর্মীয় কার্যালয় মহন্ত এস্টেট রহনপুর বাজারস্থ পূণর্ভবা নদীর কীনারায় অবস্থিত। মহন্ত এস্টেটের পাশে গড়ে ওঠে নদীর ঘাট। ঘাটে দূর দূরান্তে থেকে নৌকা ও লঞ্চ নিয়ে আসা যাওয়া করতেন রাজা-বাদশাসহ বিভিন্ন দেশি ও বিদেশিরা। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে বলছে, ঘাটের পাশে আরেকটি শ্মশানঘাট ছিল। ওই সময় হিন্দুরা চিতা দেয়ার সময় শ্মশানঘাটে টাকার কয়েন ফেলত।
আবার অনেকে বলছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনির অত্যাচারে এ মহন্ত ঘাটে এসে নৌকায় চড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও মূল্যবান জিনিসপত্র নদীতে ফেলে যায়। আবার নৌকা ডুবির ঘটনাও ঘটে। মুদ্রার খোঁজে মাটি খুঁড়তে আসা এনামুল হক পচা জানান প্রতিবছর নদীর পানি শুকিয়ে যায়। শুকিয়ে যাওয়ার পর থেকে এলাকার অনেকের সাথে কয়েকবছর ধরে তিনিও মাটি খুঁড়তে আসেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাটি খোঁড়েন। মাটির নিচে পাওয়া জিনিসপত্র বিক্রি করে প্রতিদিন তিনি ৫০০ থেকে ১ হাজার আয় করেন তিনি। এ পর্যন্ত বিভিন্ন রকম ধাতব মুদ্রা, সোনা, রুপা, তামা, চাদির সরঞ্জামসহ বাড়ির নিত্য প্রযোজনীয় জিনিসপত্র পেয়েছেন তিনি। তার ধারণা একদিন বড় ধরনের গুপ্তধন পাবেন।
শফিকুল ইসলাম নামে আচার ব্যবসায়ী জানান, রমজান মাসে ফেরি করে আচার বিক্রি করা যায় না। এছাড়া লকডাউনে বাইরে লোকজন কম, তাই পরিবারের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রতিদিন সকালে কোদাল নিয়ে মহন্ত ঘাটে এসে গর্ত করে মাটি খুঁড়ি। তিনি বলেন, বিভিন্ন আমলের ধাতব মুদ্রা, লোহা, পাথর, চাদির টুকরা পেয়ে থাকি। এসব বিক্রি করে পরিবারের আর্থিকভাবে জোগান দিয়ে থাকি। আবুল কালাম নামে আরেকজন জানান, গত ৩দিন ধরে এখানে আসছি। গতকাল পিতলের একটি ঘটি পেয়েছি। বড় ধরনের কিছু পাওয়ার জন্য আসছি। ওই ঘাট সংলগ্ন স্থানীয় গৃহবধূ শ্রাবনী সরকার জানান, প্রতিবছর পূণর্ভবা নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন এলাকার লোকজন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গুপ্তধনের আশায় কোদাল ও অন্যান্য কিছু দিয়ে নদীতে মাটি খুঁড়তে থাকে। অনেকে সোনা ও চাদির মালা, বিভিন্ন আমলের টাকা তামা ও লোহার টুকরো পাচ্ছে। আবার অনেকে এসব জিনিসপত্র কিনতে বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে আসছে।
গোমস্তাপুর উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি আতিকুল ইসলাম আজম জানান, কয়েকবছর ধরে দেখছি খরা মৌসুমে নদীর পানি শুকিয়ে গেলে শ্রমজীবী কিছু লোকজন গর্ত করে বিভিন্ন ধরনের ঘটি-বাটি, বিভিন্ন আমলের টাকার কয়েনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র পেয়ে থাকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রহনপুর মহন্ত এস্টের মহন্ত মহারাজ ক্ষিতিশ চন্দ্র আচারী জানান, এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তর এস্টেট হচ্ছে লালবাগ। দেশভাগ হওয়ার আগে প্রধান কার্যালয় চলে যায় মুর্শিদাবাদে। পাকিস্তান ও ইন্ডিয়া ভাগের পর এ দেশ পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় এস্টেট হচ্ছে এটি। ১১০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ মহন্ত এস্টেটটি।
তিনি আরও জানান, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় এস্টেটে ২৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা লুট হয়ে যায়। এস্টেটের টাকা পয়সাসহ সোনা রুপা, মূর্তি আসবাপত্রসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুন্ঠণ হয়ে যায়। পূণর্ভবা নদীটি খনন করলে অনেক হারিয়ে যাওয়া সোনা, টাকা পয়সা, রুপা ও কষ্টি পাথরের মূর্তি পাওয়া যাবে। এলাকাবাসীর দাবি, সরকারিভাবে মহানন্দা নদীর মহন্ত ঘাট ও সংলগ্ন স্থানটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাধ্যমে খনন করা হলে মোগল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের বিভিন্ন প্রকার ধাতব মুদ্রা, স্বর্ণ, রৌপ্য, চাদি, তামা ও লোহার তৈরি সরঞ্জামসহ কষ্টি পাথরের মূর্তি পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গোমস্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন