মহামারীতে বিশ্ব যেভাবে বদলেছে

মহামারীতে বিশ্ব যেভাবে বদলেছে

এক বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এই এক বছরে করোনাভাইরাস নানাভাবে পৃথিবীর ৭শ ৮০ কোটি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। এই বৈশ্বিক মহামারির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বুঝতে আমাদের আরও কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। তবে ইতোমধ্যে এর তাৎক্ষণিক অনেক প্রভাব আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারছি। এখানে আমরা করোনা মহামারির কিছু বৈশ্বিক প্রভাবের কথা উল্লেখ করছি।

মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ
২০২০ সালে কোভিড ১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী ২৭ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালে অন্য আর কী কী রোগে বেশি মানুষ মারা গেছে সেই পরিসংখ্যান এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে ধারণা করা যাচ্ছে, কোভিড সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী রোগের তালিকায় প্রথম পাঁচের মধ্যে থাকবে।

২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে মোট ৫ কোটি ৫৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে হৃদরোগে মারা গিয়েছিলো ৮৯ লাখ, স্ট্রোকে ৬২ লাখ এবং ফুসফুসের রোগে মৃত্যু হয়েছে ৩২ লাখ মানুষের। এগুলো সবই অ-সংক্রামক রোগ হিসাবে পরিচিত। এর বিপরীতে করোনভাইরাস একটি সংক্রামক রোগ।

যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড -১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রগুলোর তথ্য থেকে জানা গেছে, সেখানে গত এক বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে করোনা ভাইরাস। অথচ ফ্লু জাতীয় রোগে গত ১০ বছরের মোট মৃত্যুর সংখ্যা তিন লাখ ৬৮ হাজার।

মানসিক স্বাস্থ্য
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় একশ কোটি মানুষ মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যা করেছে সাত লাখ তিন হাজার মানুষ। মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে আত্মহত্যা ছিলো ১৭ নম্বরে। তবুও বেশিরভাগ দেশ তাদের জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র দুই শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় করে।

জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছে যে কোভিড -১৯ মহামারির ফলে দীর্ঘমেয়াদে মানসিক সমস্যার সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে এখন গবেষণা চলছে। এ সম্পর্কে বড় কোনো গবেষণা এখনও প্রকাশিত না হলেও ছোটখাট গবেষণা ও জরিপগুলো থেকে আমরা অনুমান করতে পারি, কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী দুশ্চিন্তা ও হতাশা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশ্বব্যাপী লকডাউন
ধারণা করা হচ্ছে ২০২০ সালে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ দীর্ঘ লকডাউনের মধ্যে পড়েছে। অক্সফোর্ডের সংগ্রহ করা তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালেও ১০০ টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে আবার মানুষকে বাসায় থাকার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। যদিও এ বছরের লকডাউন বেশ শিথিল, অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হচ্ছে।

কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি
বিশ্ব ব্যাংকের অনুমান অনুসারে ২০২০ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতি ৪.৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি ডলারের। আগে থেকেই অর্থনৈতিক সমস্যায় থাকা দেশগুলো আরও বেশি সমস্যাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের একটি গবেষণা অনুসারে, করোনা মহামারির অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর এক দশকেরও বেশি সময় লেগে যেতে পারে।

তবে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২১ সালে করোনা মহামারির প্রভাব থাকলেও ভ্যাকসিন ক্রয়-বিক্রয় এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বড় বিনিয়োগুলোর মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ৪.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।

বিশ্ব দারিদ্র্য ও বেকারত্ব
করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ বছরের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ধারণা অনুযায়ী, করোনা ভাইরাস ১১ কোটি ৯ লাখ থেকে ১২ কোটি ৪ লাখ মানুষকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বের ৭৩ কোটি মানুষ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশের দৈনিক ব্যায় ১.৯৯ ডলারের চেয়েও কমে গেছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ বেকারত্বের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২০ সালে ১১ কোটি ৪ লাখ মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছে। বহু মানুষ চাকরি না হারালেও অবৈতনিক ছুটিতে ছিল। অনেক মানুষ কাজ করেছে কিন্তু পূর্ণ বেতন পায়নি।

নারী ও অল্প বয়স্ক শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যও বেড়েছে। জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছে যে, মহামারির কারণে আফ্রিকায় চাকরির সুযোগ প্রায় অর্ধেক কমে যেতে পারে।

ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, করোনা মহামারির কারণে ধনীদের চেয়ে দারিদ্ররা বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে নারী, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, আফ্রিকান, আদিবাসী জনগণ এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠী।

অন্যদিকে সুইস ব্যাংক ইউবিএসের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্বের ধনী ব্যক্তিরা আরও ৩.৯ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিশ্বের শীর্ষ দশ ধনকুবের এই সময়ে ৫৪০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন।

স্কুলের বাইরে কোটি কোটি শিক্ষার্থী
ইউনেস্কোর মতে, ২০২০ সালে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ১৮৮ টি দেশের ১শ ৭০ কোটি শিক্ষার্থী অর্থাৎ বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৯৯ শতাংশের শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইউনেস্কোর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে এখনও প্রায় ৯০ কোটি অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। ২৯ টি দেশে স্কুল এখনও বন্ধ। ৬৪টি দেশে স্কুল খোলা থাকলেও ঠিক মতো ক্লাস হচ্ছে না।

যদিও অনলাইনের শিক্ষাকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, কিন্তু জাতিসংঘের হিসেবে প্রায় ৫০ কোটি শিশু বিশেষত দরিদ্র দেশ বা গ্রামীণ অঞ্চলের শিশুরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সামর্থ্য না থাকায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না।

বিমানের জন্য সবচেয়ে খারাপ বছর
২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ৪শ ৫০ কোটি যাত্রী বিমানে ভ্রমণ করেছেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারি ও লকডাউনের কারণে বিমানে ভ্রমণের বহু পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে। আন্তর্জাতিক এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের হিসেবে ২০২০ সালে মানুষের বিমানে ভ্রমণের হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ কমে গেছে।

দূষণের মাত্রা
লকডাউনের প্রথম দিকে বিশ্বব্যাপী দূষণের মাত্রা কমে গিয়েছিল। আকাশ অনেক স্বচ্ছ দেখা গেছে। ইতালির ভেনিসের বাসিন্দারা কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দূষিত খালগুলোতে স্বচ্ছ প্রবাহিত পানির প্রবাহ দেখতে পেয়েছিলেন।

তবে এটা স্বল্পকালীন ছিল। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, ২০২০ সালে বৈশ্বিক জ্বালানী সম্পর্কিত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন ৫.৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল। তবে কিছুদিনের মধ্যেই এটা আবার আগের মাত্রায় ফিরে গেছে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password