বিজেপির বাধা মমতা

বিজেপির বাধা মমতা

ভারতের ২৮টি রাজ্য ও আট কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে আয়তনের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ১৪তম, জনসংখ্যার হিসাবে চতুর্থ। তবে ভোটের হিসাবে রাজ্যটির গুরুত্ব এই সংখ্যাতাত্ত্বিকতার গণ্ডি ছাপিয়ে আরো বেশি। উপরন্তু এবারের বিধানসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ‘বাংলা দখলে’ মরিয়া বিজেপি। বিপরীতে বিনা যুদ্ধে ‘সূচ্যগ্রমেদিনী’ ছাড়তে রাজি নন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সব মিলিয়ে গোটা ভারতের চোখ এখন পশ্চিমবঙ্গের ভোটযুদ্ধে।

১৭টি রাজ্যে একক ও জোটগতভাবে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। তার পরও কেন্দ্রের শাসক দলটির বড় অতৃপ্তির জায়গা ‘পশ্চিমবঙ্গ’। আসছে বিধানসভা নির্বাচনে বাজিমাতের জন্য তাই আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে গেরুয়া শিবির। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর ডান হাত অমিত শাহ সম্ভাব্য সব উপায়ে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয়। তবে তাঁদের ‘পথের কাঁটা’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নাগরিকপঞ্জি—এনআরসি, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন—সিএএ ও জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন—এনপিআরবিরোধী চলমান আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ক্ষমতা থাকলে সরকার ভেঙে দিক বিজেপি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি-সিএএ করতে দেওয়া হবে না।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যেখানে আসন পেয়েছিল মাত্র তিনটি, আগের নির্বাচনে আসনের খাতাও খুলতে পারেনি, সেখানে এবার সরকার গঠনে তাদের আকাঙ্ক্ষা কতটা বাস্তবসম্মত?

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ভারতের ভোটের রাজনীতির খোলনলচে গত কয়েক বছরে প্রায় পুরোটাই পাল্টে গেছে। ব্যতিক্রম নয় পশ্চিমবঙ্গও। গত নির্বাচনের পর থেকে রাজ্যের উপনির্বাচনগুলোতে বিজেপি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ভালো করেছে। যে বিজেপি ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে আসন পেয়েছিল মাত্র দুটি, গত বছর বেড়ে দাঁড়ায় ১৮তে।

পরিসংখ্যান বলছে, সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছে ৪০ শতাংশ ভোট, তৃণমূল পেয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ বেশি। অথচ ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ঝুলিতে পড়েছিল ৬.১৪ শতাংশ ভোট। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তা বেড়ে হয় ১০ শতাংশ। পরিসংখ্যানের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এবারও বিজেপির আসন বৃদ্ধিরই ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে গত লোকসভায় তৃণমূলের আসন কমেছে দুই ডিজিটে। ২০১৪ সালের ৩৪ থেকে কমে ঠেকে ২২টিতে। তাই ঐকিক নিয়মে তৃণমূলের বিজয় ধরে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ—এ কথায় কেউ দ্বিমত করছে না।

এর চেয়েও বড় ভাবনার বিষয় বিজেপির জনপ্রিয়তা যতটা বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে যেন কমছে তৃণমূলের। এরই মধ্যে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন এক ঝাঁক মন্ত্রী, বিধায়ক, নেতা। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ জার্সি বদলে তৃণমূলের আঙিনা ছেড়ে গিয়ে উঠছেন বিজেপির বারান্দায়।

অবশ্য রাজনীতিতে দলবদল নতুন কিছু নয়, পশ্চিমবঙ্গে তো নয়ই। মুকুল রায়সহ বিজেপির বর্তমান নেতাকর্মীদের বড় অংশই একসময় ছিলেন কংগ্রেস-তৃণমূল-বামদের তাঁবুর তলায়। খোদ তৃণমূল আত্মপ্রকাশ করেছে কংগ্রেস ভেঙে। ২০১৬ সালের পর রাজ্য কংগ্রেসের ৪৪ এমএলএর ১৭ জনকেই তৃণমূল ভাগিয়ে নেয় তাদের শিবিরে। বলা যায়, মমতার দেখানো পথেই এবার উল্টো দিকে হাঁটছেন শুভেন্দু অধিকারীরা। বিজেপি এতে ইন্ধন জোগাচ্ছে মাত্র। সব মিলিয়ে মমতার ‘দুঃস্বপ্ন’ হয়ে উঠেছে বিজেপি।

তবে ভোটের অঙ্কের হিসাবটা এতটা সরল-সিধাও নয়। ২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় প্রায় ১০০টি আসনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিতে পারে প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট। দলিত, আদিবাসী, রাজবংশী, মতুয়া, গোর্খালিসহ দলিত, মতুয়া ও নিম্নবর্ণের (ওবিসি) হিন্দুদের ভোটও ৬ শতাংশের মতো।

কাজেই ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস যেমন এই ভোট নিজের দিকে ধরে রাখতে সচেষ্ট, তেমনই হিন্দুত্ববাদী বিজেপিও সংখ্যালঘু ভোটব্যাংকে ভাগ বসাতে সমান তৎপর। মুসলিম ভোট বিরুদ্ধে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে বিজেপি হিন্দু ভাবাবেগকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে।

ওদিকে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (মিম) সাফল্য পাওয়ার পর দলটির প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ঘোষণা করেছেন, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনে তাঁরাও প্রার্থী দেবেন। আর ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকিও সংখ্যালঘুদের দল গড়ে বিধানসভা ভোটে প্রার্থী দিতে চান। এরই মধ্যে ওয়াইসি ও সিদ্দিকির এক ছাতার তলে দাঁড়ানোর বিষয়টি মোটামুটি পরিষ্কার। সুতরাং এবার আর মুসলিমরা বাম, কংগ্রেস, তৃণমূল বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে সেভাবে ভোট দেবেন বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে আখেরে হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী বিজেপি সুধিবা পাবে।

এনডিটিভির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রবণতা বহাল থাকলে বিজেপি আগামী বিধানসভায় ১২৫টির মতো আসন পাবে। একই বিবেচনায় তৃণমূলের আসন ৫০টির মতো কমে দাঁড়াবে ১৬০টির কাছাকাছি। বাম-কংগ্রেস জোটের ফলাফলও আরো খারাপ হবে।

অর্থাৎ বিজেপির আজকের ভোটের সিন্দুকে জমা মূলত বাম ও কংগ্রেসের সাবেক সমর্থকদের ভোট। সিপিএম ও কংগ্রেসের সম্মিলিত সমর্থন এখন ১০-১২ ভাগের মতো। তাই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিবিরোধী এই দুই শক্তিকে বিজেপি আর সেভাবে আমলে নিচ্ছে না। ফলে রাজ্যটিতে মমতাই বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ। ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল বামেরা। ফলে মাঠে সিপিএম-সিপিআই-ফরোয়ার্ড ব্লকের সাংগঠনিক শক্তি এখনো এমন কিছু কম নয়। কিন্তু মমতার সঙ্গে সম্পর্ক তাদের সাপে-নেউলে। এতেও লাভ বিজেপিরই।

তবে জাতীয় পর্যায় ও রাজ্যের নির্বাচনে একই ভোটারদের পছন্দ অভিন্ন নাও থাকতে পারে। এ কথার ইঙ্গিত মেলে গত এক বছর হওয়া বিধানসভা নির্বাচনগুলোতে। সর্বশেষ বিহার নির্বাচনেও বিজেপির ভোট বাড়েনি। এর আগে দিল্লি, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা—কোথাও তারা লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় বিধানসভায় ভোট বাড়াতে তো পারেইনি, বরং কমেছে। কোথাও কোথাও এই কমতির হার দুই অঙ্কের। পাশাপাশি চলমান কৃষক আন্দোলনে অনেকটা বেকায়দায় বিজেপি। সম্প্রতি পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে তাদের ভরাডুবির কারণ যে কৃষক আন্দোলন, তা স্পষ্ট।

এখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করার মতো সর্বজনগ্রাহ্য ‘মুখ’ নেই বিজেপির। ২৯৪ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো ‘উপযুক্ত’ লোকেরও অভাব আছে তাদের। তাই হিন্দুত্ববাদ আদর্শ আর মোদি-শাহর ইমেজে ভর করে পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া পতাকা উড়বেই, তা হলফ করে বলা যায় না।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password