মধুচক্রে টাকাওয়ালা নামিদামিরাই খদ্দের

মধুচক্রে টাকাওয়ালা নামিদামিরাই খদ্দের

রাজশাহী নগর সম্প্রসারিত হয়ে নতুন নতুন অভিজাত আবাসিক এলাকা গড়ে উঠছে। গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। নগরীর এসব অভিজাত এলাকায় বসবাস করেন বড় কর্মকর্তারা। তাদের অধিকাংশের পরিবার থাকেন ঢাকায়। একাকীত্ব কাটাতে এসব কর্মকর্তা নারীসঙ্গ ভোগের নেশায় ছুটে বেড়ান। ঠিকাদার, অনুগত কর্মচারী, দালালরা সুবিধা ও নগদ টাকার লোভে তাদের চিনিয়ে দেন নগরীর বিভিন্ন ‘মধুচক্র’। মোটা টাকার বিনিময়ে তারা উপভোগ করেন নারীসঙ্গ।

জানা যায়, তেমনই নগর উন্নয়ন সংস্থার একজন বড় কর্মকর্তা বসবাস করেন রাজশাহীর অভিজাত পদ্মা আবাসিক এলাকায়। স্ত্রী থাকলেও ওই কর্মকর্তা নারী আসক্তিতে ভুগছেন। তিনি অবৈধ অঢেল টাকার মালিকও। ওই কর্মকর্তা পদ্মা আবাসিকের একটি মধুচক্রের নিয়মিত খদ্দের ছিলেন। 

সম্প্রতি পদ্মা আবাসিকের এক মধুচক্রে নারীসঙ্গ ভোগরত এ কর্মকর্তা আটকে পড়েন ফাঁদচক্রে। ফাঁদচক্রের হাতে ধরা পড়ে তার কাছ থেকে আদায় করা হয় মোটা টাকা। তবে এ কর্মকর্তার পকেট কাটা গেলে মানসম্মানের ভয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেননি।

আরও জানা যায়, সদ্য বদলি হওয়া এক রেল কর্মকর্তাও নিয়মিত রাজশাহীতে একাধিক মধুচক্রের নিয়মিত খদ্দের ছিলেন। মধুচক্রের দালালদের তার অফিসেও দেখা যেত। অফিসের লোকজনের মধ্যেও তার উত্তেজনা, উন্মত্ততা ও মাদকাসক্তি নিয়ে কানাঘুষা ছিল। অফিস করতেন রাতে। তার সরকারি গাড়িতে প্রায়ই অল্প বয়সী সুন্দরী তরুণীদের দেখা যেত।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ কর্মকর্তার বেপরোয়া জীবনাচারের বিষয়টি অবগত হয়ে সম্প্রতি তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করেছেন। আবাসিক ভবনেও তিনি প্রায়ই সরকারি গাড়িতে করে নারী নিয়ে ঢুকতেন বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একশ্রেণির সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ছাড়াও বিধিবদ্ধ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল অবৈধ টাকা কামাই করেন রাজশাহী নগরে। এসব সরকারি পদস্থ কর্মকর্তার অধিকাংশ পরিবারই থাকেন ঢাকায়।

সম্প্রতি নগরের উপশহরের একটি বাসায় রেলের একজন কর্মকর্তাকে নারীর সঙ্গে আপত্তিকর করে ভিডিওচিত্র ধারণ, বিকাশে টাকা আদায় করে ছেড়ে দেওয়া ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে এক যুবক ও দুই তরুণীকে গ্রেফতার করে বোয়ালিয়া থানার পুলিশ। তবে ভুক্তভোগী রেল কর্মকর্তা মধুচক্র থেকে ছাড়া পেয়েই পুলিশের কাছে যান।

বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ বলেন, যারা নারী আসক্তির নেশায় মধুচক্রে যান তাদের অনেকেই এ ধরনের প্রতারণার ফাঁদেও পড়েন। মানসম্মানের ভয়ে অনেকেই মোটা টাকা দিয়ে ছাড়া পেলেও পুলিশের কাছে আসে না অভিযোগ দিতে। ফলে পুলিশ এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না।

তিনি বলেন, নানান পেশার মানুষ এসব মধুচক্রের খোঁজ পেয়ে সেখানে যান দালালদের মাধ্যমে। তবে অনেকেই প্রতারণার ফাঁদে পড়েন। নগ্ন নারীর সঙ্গে ছবি তুলে ব্লাকমেইল করা হয়। কেউ অভিযোগ করেন আবার কেউ টাকা দিয়ে রফাদফা করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীর অভিজাত আবাসিক উপশহর, পদ্মা আবাসিক, ভদ্রা, কলাবাগান, বিলসিমলা, নগরীর উপকণ্ঠ বায়া, নওদাপাড়া, আমচত্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ‘মধুচক্র’। আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে গড়ে উঠেছে এসব ‘মধুকুঞ্জ’।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সুন্দরী তরুণীদের রাজশাহীতে এনে আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে মধুচক্র গড়ে তুলেছে একাধিক চক্র। টাকাওয়ালা উঠতি নেতা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার কর্মকর্তারা এসব মধুচক্রের নিয়মিত খদ্দের।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, কিছুদিন আগে একজন সাব-রেজিস্ট্রার নগরীর একটি মধুচক্রের নিয়মিত খদ্দের ছিলেন। পরে চক্রের সঙ্গে জড়িত একটি দুর্বৃত্তরা নারীসহ আপত্তিকর অবস্থায় ভিডিও করে তার কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে নিয়ে ছাড়েন। তবে ওই সাব-রেজিস্ট্রার কোনো অভিযোগ না করায় পুলিশ জানলেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

একজন ম্যাজিস্ট্রেটও মধুচক্রের এমন ফাঁদে পড়ে টাকা খুইয়েছেন বলে পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ না করায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ। তবে তারা টাকা উদ্ধারসহ ফাঁদচক্রের কয়েকজনকে ধরে অন্য মামলায় চালান করেন।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, রাজশাহীতে মধুচক্রের রমরমা কারবার চললেও সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় এগুলো পুলিশ খুব সহজে শনাক্ত করতে পারেন না।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মতে, অভিজাত এলাকায় বাড়িভাড়া নিয়ে এসব মধুচক্র চলে। অনেক প্রভাবশালীরা এসব চক্রের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আবার অনেক নামিদামি লোকও এসব মধুচক্রের নিয়মিত খদ্দের হন বলে জানার পরও প্রতিবেশী কিংবা অন্য কেউ এসব অপকর্মে বাধা দিতে পারেন না। পুলিশও অনেক সময় এড়িয়ে চলেন। তবে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে পুলিশ আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, অভিজাত এলাকায় নানান কায়দা কৌশলে বাসাবাড়িতে মধুচক্র চালানো হয় বলে অভিযোগ আছে। রাতে দিনে অচেনা অপরিচিত মানুষের আনাগোনা দেখে অনেকেই পুলিশকে ফোন করেন।

তিনি বলেন, পুলিশ অনেক সময় অভিযান পরিচালনা করেন। মধুচক্র শনাক্তে মহানগর পুলিশ সাম্প্রতিক সময়ে নজরদারি বাড়িয়েছেন। কারণ এসব মধুচক্রের গোপন নেশার আনন্দ বিনিময়ই হয় না, নানান প্রতারণা ও অপরাধও সংঘটিত হয়। পুলিশ বিভিন্ন উপায়ে এসব মধুচক্র শনাক্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আরএমপির থানা ফাঁড়িগুলোকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password