সাধারণভাবে বলা যায়, মধু মানে লাখ লাখ মৌমাছির অক্লান্ত পরিশ্রম আর সেবা ব্রতী জীবনের দান। প্রাচীনকাল থেকেই মধুর গুনাবলি খাদ্য ও ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মধু এক প্রকার মিষ্টি ও আরোগ্য পদার্থ, যা মৌমাছি এবং অন্যান্য পতঙ্গ বিভিন্ন ফুলের নির্যাস থেকে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি করে থাকে এবং মৌচাক এ সংগ্রহ করে। মধু মূলত সুগন্ধি মিষ্টি, ঔষধিগুণ সম্পন্ন ভেষজ তরল; এটি সুপেয় ও বটে। মধুর বিশিষ্ট গন্ধ, স্বাদ এবং গুন এর কারণে, অনেকে চিনির চাইতে মধুকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। মধুর একটি অনন্য গুন হল, এই কখনও নষ্ট হয় না। দীর্ঘ বছর ধরে সংরক্ষণ করলেও মধুর গুণাগুণ বিদ্যমান থাকে। মধু আধুনিক খাবার বা শরবতের সাথে ব্যবহার করা হয়। মিষ্টির পরিপূরক হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। যে কারণে খাবারের স্বাদের পাশাপাশি, স্বাস্থ্যগুণও বজায় থাকে। এছাড়াও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মধুর ব্যবহার এবং উপকারিতার নির্দেশ পাওয়া যায়। মধুর নানা পুষ্টিগুণ, স্বাদ ও ঘ্রাণ এর কারণে সর্বত্র এর গ্রহণযোগ্যতা অতুলনীয়। প্রাচীনকাল এর বৈদ্য বা কবিরাজ বাবুদের থেকে বর্তমান এ নানান ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের মুখে মুখে মধুর গুণগান শুনতে পাওয়া যায় অহরহ।
বাংলাদেশে অনেক রকমের মধু পাওয়া যায়। এর মধ্যে সুন্দরবন এর মধু শ্রেষ্ঠ বলে মানা হয়। এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় হানি প্ল্যান্ট গাছের খলিশা ফুলের মধু বা পদ্ম মধু, শুর ফুলের মধু, সরিষা ফুলের মধু, কালিজিরা ফুলের মধু, সুন্দরবনের গেওয়া ফুলের মধু ও প্রাকৃতিক ফুলের মধু।
মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। এর মধ্যে অন্যতম ফ্রুক্টোজ, সুক্রোজ, মন্টোজ, অ্যামাইনো অ্যাসিড, খনিজ লবণ, এনজাইম, ক্যালরি, আয়োডিন, কপার সহ অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৫, বি৬ এর মত উপাদান।
মধু শরীর ও মন শান্ত করে, গভীর ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুম এনে দয়, ওজন নিয়ন্ত্রণ করে, শক্তি যোগায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে, গলা ব্যথা ও কাশির উপশম করে, হৃদ্রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে, রক্তস্বল্পতা দূর করে, ত্বক ও চুলের যত্নে, ক্ষত নিরাময়ে কাজ করে।
আসল মধু চেনা এখন বেশ কঠিন, কারণ বাজারে অনেক ভেজাল মধু পাওয়া যায়। তবে কিছু সহজ পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে আপনি আসল এবং নকল মধুর মধ্যে পার্থক্য করা যায়।
আসল মধু চেনার সহজ উপায়:
•পানি পরীক্ষা (Water Test):
O একটি গ্লাসে সাধারণ তাপমাত্রার পানি নিন।
O এবার এক চামচ মধু গ্লাসের পানিতে আলতো করে ছেড়ে দিন।
O যদি মধু দলা পাকিয়ে গ্লাসের নিচে জমাট বেঁধে থাকে এবং সহজে না মেশে, তাহলে সেটি খাঁটি মধু।
O আর যদি মধু দ্রুত পানির সাথে মিশে যায় বা ছড়িয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে তাতে ভেজাল (যেমন চিনি বা সিরাপ) মেশানো আছে।
•আগুন পরীক্ষা (Flame Test):
O একটি তুলার বল বা কটন বাডে কিছুটা মধু মাখিয়ে নিন।
O এবার একটি ম্যাচ দিয়ে তাতে আগুন ধরানোর চেষ্টা করুন।
O যদি তুলার বলটি সহজে জ্বলে ওঠে এবং মধু জ্বলতে থাকে, তাহলে এটি খাঁটি মধু।
O যদি এটি না জ্বলে বা জ্বলতে পটপট শব্দ হয়, তাহলে বুঝবেন মধুতে পানি বা অন্যান্য ভেজাল মেশানো আছে।
•টিস্যু পেপার/ব্লটিং পেপার পরীক্ষা (Paper Test):
O একটি টিস্যু পেপার বা ব্লটিং পেপারের উপর কয়েক ফোঁটা মধু ফেলুন।
O যদি মধু পেপার শুষে না নেয় বা খুব ধীরে ধীরে শোষিত হয়, তাহলে এটি খাঁটি মধু।
O যদি মধু দ্রুত শোষিত হয়ে যায় এবং পেপারটি ভিজে যায়, তাহলে মধুতে পানি মেশানো আছে।
•ঠান্ডা/ফ্রিজ পরীক্ষা (Freezing Test):
O একদিনের জন্য একটি পাত্রে মধু নিয়ে ডিপ ফ্রিজে রাখুন।
O একদিন পর বের করে দেখুন। খাঁটি মধু জমে শক্ত হবে না, বরং কিছুটা ঘন হবে।
O যদি মধু পুরোপুরি বা আংশিকভাবে জমে যায়, তাহলে বুঝতে হবে এটি নকল বা ভেজাল মিশ্রিত মধু।
•আঙুল পরীক্ষা (Thumb Test):
O আপনার আঙুলের ডগায় সামান্য মধু নিন।
O খাঁটি মধু ঘন হবে এবং সহজে ছড়িয়ে পড়বে না। এটি আঠালো এবং ঘন হয়ে লেগে থাকবে।
O যদি মধু দ্রুত ছড়িয়ে যায় বা পাতলা মনে হয়, তাহলে এটি ভেজাল হতে পারে।
•পিঁপড়া পরীক্ষা (Ant Test):
O এক টুকরা কাগজে কিছু মধু নিন এবং যেখানে পিঁপড়া আছে সেখানে রেখে দিন।
O যদি পিঁপড়া মধুর ধারে কাছে না আসে বা এটিকে এড়িয়ে চলে, তাহলে এটি খাঁটি মধু।
O কারণ খাঁটি মধুতে থাকা এনজাইম পিঁপড়াদের জন্য আকর্ষণীয় নয়। যদি পিঁপড়া এটিকে ঘিরে ধরে বা খেতে শুরু করে, তাহলে এটি নকল মধু হতে পারে, কারণ এতে চিনি বা অন্যান্য মিষ্টি দ্রব্য মেশানো আছে।
•ফেনা ও গন্ধ পরীক্ষা (Foam & Smell Test):
O আসল মধুতে সাধারণত ফেনা হয় না।
O নকল মধুতে অনেক সময় ফেনা দেখা যায় এবং এর গন্ধও তেমন ভালো হয় না, অনেক সময় টকটক গন্ধ থাকে। খাঁটি মধুর একটি মিষ্টি ও প্রাকৃতিক সুগন্ধ থাকে।
এই পরীক্ষাগুলো আসল ও নকল মধু চিনতে সাহায্য করবে। তবে মনে রাখা ভাল, কিছু পরীক্ষার ফলাফল মধুর উৎস এবং প্রক্রিয়াকরণের উপর ভিত্তি করে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি বিশ্বস্ত উৎস থেকে মধু কেনা যায়।
মধু একটি প্রাকৃতিক উপাদান হলেও, ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধু খাওয়ানো উচিত নয়, কারণ এতে বোটুলিজম (botulism, এক ধরনের অসুস্থতা) হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়াও, ডায়াবেটিস রোগীদের মধু গ্রহণে পরিমিত থাকা উচিত এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া ভালো।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন