পশ্চিমা শিক্ষাবিদদের কিনছে চীন

পশ্চিমা শিক্ষাবিদদের কিনছে চীন

বেইজিং কীভাবে পশ্চিমা শিক্ষাবিদদের আনুকূল্য কিনে নিচ্ছে তা নিয়ে ফরাসি সাপ্তাহিক লে পয়েন্ট একটি চমকপ্রদ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। উদাহরণ হিসেবে ইতালির ফ্লোরেন্সের লরেঞ্জো ডি মেডিসির অধ্যাপক ফ্যাবিও ম্যাসিমো পেরেন্তির কথা বলা যাক। তাকে চীনের জিনজিয়াংয়ে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। সেখানে প্রায় দুই মিলিয়ন উইঘুরকে ‘পুনঃশিক্ষা শিবির’ নামধারী ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রাখা হয়েছে।

ইতালির বাইরেও অনেক ব্রিটিশ স্কুল এখন চীনা প্রভাব ও প্রচার বিষয়ক রাডারে রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে: এবটস ব্রমলি স্কুল, বোর্নমাউথ কলেজিয়েট, সেইন্ট মিশেলস স্কুল, বসঅর্থ কলেজ, বেডস্টোন কলেজ, ইপসউইক হাইস্কুল, কিংসলে কলেজ, হিটফিল্ড স্কুল, থেডফোর্ড গ্রামার, উইসবেক গ্রামার, রিডেলসঅর্থ হল, মিডলটন কলেজ, ক্যাটস কলেজ।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পশ্চিম চীনের জিনজিয়াংয়ের উইঘুর অঞ্চলের রাজধানী উড়ুমকিতে স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অনারারি ডিন ক্রিশ্চিয়ান মস্ত্রে এক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। সেমিনারের বিষয় ছিল, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, জঙ্গিবাদ নির্মূল এবং মানবাধিকার রক্ষা।’ চীনের সরকারই এই সেমিনারের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে মস্ত্রের দেওয়া বক্তব্য চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদসংস্থা জিনহুয়া নিউজ এজেন্সি ও জাতীয়তাবাদী পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস এ ছাপা হয়।

এসময় একটি ‘পুনঃ শিক্ষা শিবির’ পরিদর্শনকালে অধ্যাপক মস্ত্রে বলেন, আমি আশা করি, ফ্রান্স এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলি জিনজিয়াংয়ের দেওয়া উত্তরগুলি গ্রহণ করতে পারবে। এখানে কেউ বন্দি হিসেবে নেই, শুধু বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণে আছে।

এই ঘটনার পরই চীন কীভাবে বহু পাশ্চাত্য শিক্ষাবিদদের নিজের পক্ষে কিনেছে সে সম্পর্কে ফরাসী সাপ্তাহিক লে পয়েন্টের চিত্তাকর্ষক তদন্ত শুরু হয়েছিল। অধ্যাপক মস্ত্রের এক সহকর্মী মেরি বাইজেস-লিং বলেন, এটি সোভিয়েত ইউনিয়ন বা নাজি জার্মানির সহযোগীদের জন্য আরাগন ভ্রমণের উপযুক্ত।

আরাগন হচ্ছেন ফরাসী লেখক লুই আরাগন। তিনি স্ট্যালিনের অধীনে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিদর্শন করেছিলেন এবং কমিউনিস্ট ব্যবস্থার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন।

সম্প্রতি জিনজিয়াংয়ের চীনের পুনঃশিক্ষা শিবিরের এক সাবেক বন্দি সেখানে কী ঘটেছিল তা প্রকাশ করে। তার নাম গুলবাহার হাইতিবাজি, তিনি দশ বছর ফ্রান্সে ছিলেন। তার স্বামী ও কন্যারা ফ্রান্সে রাজনৈতিক শরণার্থী ছিলেন। তবে গুলবাহার তার বয়স্ক মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য নিজের চাইনিজ পাসপোর্ট রেখে দিয়েছিলেন।

২০১৬ সালের নভেম্বরে তিনি চীনে যান। যাওয়ার পর তাকে একটি পুনরায় শিক্ষা শিবিরে নির্বাসন দেওয়া হয়। সেখানে তিনি দুই বছর বন্দি ছিলেন। এই বছরের শুরুর দিকে মুক্তি পেয়ে তিনি বন্দিশিবিরের রক্ত হিম করা বিবরণ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। তার এই জবানবন্দীকে বলা হয় ‘সার্ভাইবাল অফ চাইনিজ গুলাগ।’

গুলবাহার হলেন প্রথম উইঘুর মুসলিম যিনি মুক্তি পেয়ে ফ্রান্সে প্রত্যাবাসন করেছেন। চীনা প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শি জিনপিং উইঘুর ছাড়া জিনজিয়াং চায়।’ডিটেনশন সেন্টার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘উইঘুরদের কথা বলা নিষেধ, নামাজ পড়া নিষিদ্ধ; অনাহারে থাকা নিষিদ্ধ।’ এমনকি অন্যের সামনে তাকে প্লাস্টিকের বালতিতে মলত্যাগ করতে হয়েছিল।

বন্দি হওয়ার পরের বছর ২০১৭ সালে গুলবাহারকে টানা ২০ দিন বিছানায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। মরুভূমির কিনারায় ছোট বিমানবন্দরের মতো বড় তিনটি বিল্ডিং নিয়ে গঠিত বেইজিন্টন শিবিরে ছিলেন গুলবাহার। পুরো এলাকা ঘিরে কাটাতারের বেড়া ছিল। বন্দিদের সূর্যের আলো দেখতে দেওয়া হতো না। বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকা অসংখ্য ক্যামেরা দিয়ে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করা হতো।

এসব শিবিরে বন্দিদের কোনো নাম ছিল না, প্রত্যেককে একটি করে নাম্বার দেওয়া হতো। গুলবাহারের নম্বর ছিল ৯। সবার চুল কেটে ফেলা হতো। এরপর বন্দিদের মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়া হতো। তাদের একটি দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গার্ডরা জিজ্ঞেস করতো দেওয়ালের রঙ কী। সাদা দেওয়াল দেখে বন্দিরা সাদা বলেই উত্তর দিতো। কিন্তু গার্ডরা বলতো, না, এইটা কালো। রঙ আমরা যেটা বলব সেটাই।

এরপর নতুন বন্দিদের একটি ওষুধ দেওয়া হয়।গুলবাহার বলেন, ওষুধটা দেওয়ার পর নারীদের মাসিক বন্ধ হয়ে যায় এবং ফ্রান্সে ফিরে টের পাই যে আমার আর সন্তান নেওয়ার ক্ষমতা নেই।

ফ্রান্সে গত ১৫ বছরে ১৮টি কনফুসিয়াস সেন্টার খোলা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে চীন ও চীনের সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়। ২০১৯ সালে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে এমন একটি কনফুসিয়াস সেন্টার নিষিদ্ধ করে বেলজিয়াম। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজেস এন্ড সিভিলাইজেশনের (ইনালকো) তিব্বত বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সিসকো রবিন এসব সেন্টারকে ‘প্রোপাগান্ডা ওয়েপন’ বলে অভিহিত করেন।বিখ্যাত আন্তর্জাতিক পত্রিকা দ্যা ইকোনমিস্ট বলেছে, চাইনিজরা তিব্বতের নাগরিকদের মন থেকে বৌদ্ধ ধর্ম মুছে ফেলছে। এ কারণেই সিআইএ'র নতুন চীফ উইলিয়াম জে বার্নস বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কনফুসিয়াস সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

এমন উদ্বিগ্নতা ব্রিটেনেও ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির অন্যতম পত্রিকা ডেইলি মেইল বলেছে, করোনা মহামারীর কারণে আর্থিক দুরবস্থায় থাকা শত শত স্বাধীন স্কুলকে চীনা বিনিয়োগকারীরা টার্গেট করেছে। স্পষ্টতই চীন ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে ব্রিটেনের ১৭টি স্কুলের মালিকানা কিনে নিয়েছে বিভিন্ন চাইনিজ কোম্পানি।

একসময় অনেক পশ্চিমা নাগরিকই বলতে পারতেন না সোভিয়েত ইউনিয়ন আসলে কত মানুষকে হত্যা করেছে বা বন্দি করে রেখেছে। এখন আমরা সোভিয়েত না হোক, চীনের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে জানি। উহানে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটিও চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির গণহত্যার অস্ত্র ছিল। তারা এই ভাইরাস দিয়ে বিশ্বব্যাপী ২৫ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে।

এর বাইরে আমরা চাইনিজদের ‘প্রশাসনিক কারাগার’ লওগাইয়ে আটকে থাকা লোকের সংখ্যা সম্পর্কেও জানি। সেখানে আনুমানিক পাঁচ কোটি মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। ‘একটি শিশু নীতি’ কার্যকর হওয়ার সময় যখন চীন মেয়েশিশুদের জন্ম হতে দেয়নি সেই সংখ্যা সম্পর্কে আমরা জানি। আনুমানিক প্রায় তিন কোটি শিশুকে গর্ভেই মেরে ফেলা হয়। আমরা তিয়েনয়ামেন স্কয়ারে ১০ হাজার লোকের গণহত্যা সম্পর্কে জানি।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের বার্ষিক অধিবেশনকে ইঙ্গিত করে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং জি বলেছেন, ‘জিনজিয়াং এবং তিব্বতের মতো জাতিগত সংখ্যালঘুদের বসবাসের জায়গাগুলি চীনে মানবাধিকার অগ্রগতির উজ্জ্বল উদাহরণ।’ সম্ভবত সোভিয়েত ইউনিয়নও এমন কথা বলতে পারত না।

(লেখক: গিয়েলিও মেটি। তিনি একজন ইতালিয় সাংবাদিক। তার এই লেখাটি গেটস্টোন ইন্সটিটিউটের ওয়েবসাইট থেকে অনূদিত)

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password