পরগনায় দায়িত্বে থাকা আছিয়া খাতুনের আথিতিয়েতা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি এলাকাটি দেখে খুবই পছন্দ করেন। পরে তিনি এ পরগনায় মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এরপর আছিয়া খাতুনের সঙ্গে আলোচনা করে মসজিদের কাজ শুরু করেন। মসজিদটি দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন ঐ সময়কার তার পৃষ্ঠপোষক মুসলমান সাহিত্যিক আমির জয়েন উদ্দিন, আমির শিহাব উদ্দিন কিরমানী ও মনসুর সিরাজী। এক পর্যায়ে জৌনপুরের শাসনকর্তা মাহমুদ শর্কী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসুকে নিয়ে বরবক শাহ তার রাজ্য, গৌড়ে ফিরে যান। এরপর ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে বরবক শাহ পরলোক গমন করেন। পরে জৌনপুরের মাহমুদ শর্কী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসুর মুখে পিতার মসজিদের অসমাপ্ত কাজের বর্ণনা শুনে বরবক শাহের পুত্র সামসুদ্দিন আবু মুজাফফর ইউসুফ শাহ মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করার তাগিদ দেন। ইউসুফ শাহ দেহরক্ষী বাসুদেব বসুকে সঙ্গে নিয়ে আছিয়া খাতুনের পরগনায় আসেন ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে । এসময় তিনি পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত মসজিদ নির্মাণের কাজ শেষ করার তাগিদ দেন। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর বরবক শাহের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয় শাহী মসজিদ। মসজিদের দায়িত্বভার আমির জয়েন উদ্দিন হারাভী, আমর শিহাব উদ্দিন ও মনসুর সিরাজীকে বুঝিয়ে দিয়ে ইউসুফ শাহ পৃষ্ঠপোষক বাসুদেব বসুকে নিয়ে তার রাজ্য ফিরে যান। বরবক শাহ’র আমলে চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জেও দুটি মসজিদ নির্মাণ করা হয় জনশ্রুতি আছে।
জানা যায়, মোগল আমলের পতনের পরে ১৮৮৬ সালে ইংরেজ শাসনামলে তৎকালীন জমিদার জগদীশচন্দ্র বসু মসজিদটি মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলেন। পরে তার পাশেই জমিদাররা হিন্দুদের তীর্থস্থান তৈরি করেন। একপর্যায়ে মসজিদটি জঙ্গল দিয়ে ঢেকে যায়। এর চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যায়নি। ১৯২৫ সালের দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর অপর পাড়ে ইছাখালী এলাকার শমসের মিয়া নামে পথচারী একদিন এর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এসময় তিনি পাশ থেকে সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তেলওয়াত ও আজানের গায়েবি ধ্বনি শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ান। এ নিয়ে তার কৌতূহলও বেড়ে যায়। একদিন সে জঙ্গল পরিষ্কার করে ও মাটি খোদাই শুরু করে। পরে গম্বুজ দেখতে পেয়ে আশপাশের লোকজনকে ডেকে আনেন। পরে শমসের মিয়া পরিষ্কার করে দাঁড়িয়ে আজান দেন। তৎকালীন সময়ে স্থানীয় জমিদার ও মুসলমানদের মধ্যে বিবাদ ও কলহের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে, মতান্তরে জমিদার লোক কর্তৃক গুলিতে সমশের মিয়া মৃত্যুবরণ করেন। শমসের মিয়াকে পরগনার মালিক আছিয়া খাতুন ও মুসলমান তিন সাহিত্যিক আমির জয়েন উদ্দিন হারাভী, আমির শিহাবউদ্দিন ও মনসুর সিরাজীর পাশেই দাফন করা হয়। শাহী মসজিদের প্রাচীরের বাইরে উত্তরপূর্ব কোণায় এ পাঁচটি কবর। উল্লেখ থাকে যে, হত্যার অভিযোগে কলকাতা আদালতে শমসের মিয়ার মা জমিলা খাতুন মামলাও দায়ের করেন।
বর্গাকার মসজিদটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ৪০ ফুট করে। চারপাশের দেয়াল ছয় ফুট আট ইঞ্চি চওড়া। পূর্বপাশে রয়েছে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ। এই ইটের দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চি এবং চওড়া ২ ইঞ্চি। বর্তমান যুগের ইটের চেয়ে এর আকৃতি একেবারেই আলাদা। মোগল আমলের মসজিদ ছিল এক গম্বুজ বিশিষ্ট। এটি সিরামিকের (স্থানীয় ভাষায় চিনামাটি) টুকরা দিয়ে নকশা করা হয়েছে, কিছু অংশে চাঁদ তারা খচিত রঙিন সিরামিকের টুকরা বসানো রয়েছে। মসজিদের গম্বুজ খাঁজকাটা, যা দৃষ্টিনন্দন। গম্বুজের চূড়া গোলাকার ও সুচালো। খিলানের চারপাশ লতাপাতার কারুকাজ এবং ভেতরের নকশা চোখে পড়ার মতো। মোগল আমলের গম্বুজের সাদৃশ্য বজায় রেখে জমিদারি প্রথা বাতিলের পর আরও দুটি গম্বুজ তৈরি এবং সাদা চিনামাটির বা সিরামিকের ভাঙ্গা টুকরো দিয়ে এটারও আচ্ছাদিত করা হয়। মসজিদটি নির্মিত হয় তিন কাতারের এবং সংযোজিত হয় দুই কাতার বিশিষ্ট বারান্দা, ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী মেহরাব স্থানান্তরিত হয় মসজিদের মাঝে। প্রায় ৩০০ লোক নামাজ আদায় করতো পারতো।
তাছাড়া মসজিদের বারান্দা থেকে প্রায় ৪ মিটার দূরে পুরোনো ও নতুন গম্বুজের মাঝামাঝি, একটি মিনার তৈরি করা হয়ে ছিল, তবে সেই মিনারটি ১৯৯০ সালের পরে ভেঙে ফেলা হয় এবং মুসল্লিদের নামাজের স্থান সংকুলানের জন্য মসজিদের পুরোনো বারান্দার সাথ অস্থায়ীভাবে টিনশেডের আর একটা বারান্দা সংযোজিত হয়। মসজিদের ছাদে ৩টি গম্বুজ ব্যতীত রয়েছে ১২ টি মিনার। ব্যাসে ৬ টি এক পরিমাপের, বাকি ৬ টি তুলনামুলকভাবে কম। প্রাচীর ঘেরা মসজিদের প্রধান ফটক পূর্ব দিকে, যা বর্তমানে তালাবদ্ধ। তাছাড়া ২০১৭ শমসের মিয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত হয় পাঠাগার।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন