রুবিনাকে হাসপাতালে না নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিল ভিডিও করায়

রুবিনাকে হাসপাতালে না নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিল ভিডিও করায়
MostPlay

মোটরসাইকেলে করে দেবর মো. নুরুল আমিনের সঙ্গে হাজারীবাগে ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন গৃহিণী রুবিনা আক্তার। কিন্তু শাহবাগ মোড় পার হয়ে জাদুঘরের কাছে গেলে পেছন থেকে একটি প্রাইভেট কারের ধাক্কায় পড়ে যান রুবিনা। তবে গাড়িচালক ধাক্কা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, রুবিনাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যান সেখান থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত।

পথচারীরা গাড়ি থামাতে চিৎকার করলেও ওই শিক্ষক থামাননি, বরং গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। গাড়ির পেছন পেছন সাইকেল চালিয়ে তাকে আটকাতে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী। একসময় গাড়িটির কাছে গিয়ে পৌঁছেও যান তিনি। ওই দিনের ঘটনা তিনি শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। লিখেছেন ওই দিন যা যা ঘটেছিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করেছেন নিজের ক্ষোভও।

তাঁর ফেসবুকের লেখাটি পাঠকদের জন্য নিচে দেওয়া হলো- ‘রুবিনা আক্তারকে এক কিলোমিটরের বেশি রাস্তা টেনে নিয়ে গাড়িটা যখন নীলক্ষেত মোড়ে থামল, সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে আপনার তখন কী আশা করা উচিত? তাকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে পাঠানো এবং গাড়িসহ ড্রাইভারকে আটক করে উত্তমমাধ্যম দিয়ে পুলিশে দেওয়া। আমি এটা চাইতাম এবং আমি নিশ্চিত আপনারাও এটা চাইতেন।

কিন্তু আমাদের চাওয়া এবং কাজের মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক। সাইকেল নিয়ে প্রাইভেট কারের পিছু নিয়ে যখন নীলক্ষেত পৌঁছলাম ততক্ষণে উত্তেজিত জনতা গাড়ি থামিয়ে ভিকটিমকে গাড়ির নিচ থেকে বের করে ফেলেছে। ড্রাইভারকে বের করে ধোলাই করছে জনতা। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে গালি দিচ্ছে। আর একটা হলেও কিল-ঘুষি-লাথি মারার চেষ্টা করছে ড্রাইভার এবং গাড়িতে। এক বান্দা গাড়ির ছাদেও উঠে গেছে। লাথি দিয়ে দিয়ে উইন্ডশিল্ড আর উইন্ডো গ্লাস ভাঙায় ব্যস্ত সে।

আর এই মারামারি-ভাঙচুরের দৃশ্য ভিডিও করতে ব্যস্ত আরেক দল মানুষ। সবাই এত ব্যস্ত, এত উত্তেজিত যাকে কেন্দ্র করে- সেই রুবিনা আক্তার নিথরভাবে পড়ে আছে রাস্তার অন্য পাশে। শুধু হৃৎপিণ্ডটা ছটফট করছে। তাঁকে ঘিরে ছবি তোলা, আর ভিডিওতে ব্যস্ত একদল মানুষ, আরেকদল ব্যস্ত পকেটে হাত দিয়ে অ্যাকসিডেন্টের দুঃখে হা-হুতাশ করতে। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে-এটা কারো মনে পড়ছে না। সবাই ভুলে গেছে।

সাইকেল নিয়ে ভিড় ঠেলে যতটুকু সম্ভব সামনে গিয়ে এক রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম, মামা জলদি রিকশা আনেন! হাসপাতালে নেওয়া লাগবে। আমার মায়ের সেই ভাই, রিকশা পিছিয়ে উল্টো দিকে চলে গেল। চিল্লায়ে যতই বলি কেউ একটা রিকশা ডাকেন, হাসপাতালে নেওয়া লাগবে, কেউ একটা ভ্যান ডাকেন- কেউ-ই কথা কানে নেয় না। সবাই ব্যস্ত ভিডিও করতে। কয়েক মুহূর্ত পরে এক ভাই একটা ভ্যান নিয়ে এলো পেছন থেকে। ভ্যানে তুলে রুবিনা আক্তারকে নেওয়া হলো ঢাকা মেডিক্যালে।

ইমার্জেন্সিতে তাঁর সঙ্গে ছিল মাত্র একজন আপু। যিনি নিজেও র‍্যানডম একজন পথচারী। ইমার্জেন্সিরুম থেকে যখন ইসিজিরুমে নিয়ে যাচ্ছিলাম রুবিনা আক্তারকে, তখন ওই আপু কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন বারবার। ইসিজিরুম থেকে রিপোর্ট নিয়ে ইমার্জেন্সিরুমে ব্যাক করার পর যখন সার্টিফাই করল ‘শি ইজ নো মোর’, ওই আপু আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লেন আরেকবার। ইমার্জেন্সিরুমে আরেকজন ভাই ছিল। কথা বলার একপর্যায়ে জানতে পারলাম তিনি সাংবাদিক।

আপুর থেকে, আমার থেকে বেশ কিছু তথ্য নিলেন। ভিকটিমকে যখন ডেড ঘোষণা করা হলো তখনো তাঁর ফ্যামিলির কেউ উপস্থিত নেই সেখানে। ওনার দেবর ছিলেন রক্তের খোঁজে বাইরে। আছি শুধু আমি আর ওই আপু, আর দুই সাংবাদিক ভাই। এই যে মানুষের ব্যবহার- একজন মুমূর্ষু ব্যক্তিকে ফেলে রেখে ছবি তোলা বা ভিডিও করা, এগুলো কিভাবে শুরু হলো বা এর থেকে উত্তরণের উপায় কী? আমার জানা নেই। আছে শুধু একরাশ খারাপ লাগা অনুভূতি।

আগে অনেক শুনেছি অসহায় মানুষকে ফেলে রেখে মানুষ ফটোগ্রাফি-ভিডিওগ্রাফি-লাইভ স্ট্রিমিংয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। আজ নিজে প্রত্যক্ষ করলাম। পথচারী লোকগুলো কি পারত না রুবিনা আক্তারকে ভিডিও না করে সঙ্গে সঙ্গেই মেডিক্যালে নিয়ে যেতে বা ওই রিকশাওয়ালা মামা কি পারত না এগিয়ে আসতে? বা ওই সাংবাদিক ভাইটির দায়িত্ব কি শুধুই তথ্য কালেক্ট করা? দায়িত্বের ঊর্ধ্বে মানবিকতা বলে কি কিছু নেই? তিনি কি পারতেন না রোগীর স্বজন কেউ আসা অবধি আমাদের সঙ্গে অপেক্ষা করতে? মানবিক দিক বিবেচনা করার মতো মানবিকতাও আমাদের মধ্যে আর নেই। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানবিকতা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে!’

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password