রিখটার স্কেলে যদি ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়, সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে না ঢাকা৷ ধ্বসে পড়বে কয়েক হাজার ভবন, মৃত্যু হবে অন্তত দুই থেকে তিন লাখ মানুষের৷ এমনটাই মনে করছেন ভূমিকম্প বিশ্লেষকরা৷ ময়মনসিংহের মধুপুর ফল্টে যদি ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে রাজধানীর প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে বলে আশঙ্কা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের।
আর্থ অবজারভেটরি সেন্টার বলছে, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও মিয়ানমার--- এই তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে বাংলাদেশ। তাই, এ অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় দফায় দফায় শক্তিশালী ভূমিকম্পে মারাত্মক বিপর্যয়ের পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রিখটার স্কেলে যদি সাত মাত্রার ভূমিকম্প হয়, সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে তো ঢাকা?
তেমনটি হলে ধ্বসে পড়বে কয়েক হাজার ভবন, মৃত্যু হবে অন্তত দুই থেকে তিন লাখ মানুষের৷ এমনটাই মনে করছেন ভূমিকম্প বিশ্লেষকরা। ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশ। সেবার আতঙ্কেই মারা যান ৬ জন। গত ১৫ বছরে ছোট-বড় ভূমিকম্পে ১৪১ বার কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ভূমিকম্পগুলো বড় ভূমিকম্পের আলামত। আবার বড় ভূমিকম্পের শত বছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়। সে দিক থেকেও আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকট। ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের পর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োজনীয় খোলা জায়গা নেই ঢাকা শহরে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) মেনে চলার নির্দেশনা থাকলেও রাজধানীর বেশির ভাগ ভবন মালিকই তা মানছেন না।
এ বিষয়ে আইন হওয়ার প্রায় ১৫ বছর পরও এটি ঠিকমতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজধানীতে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং ভূমিকম্পে ক্ষতির আশঙ্কা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারি বলেন, ‘‘গত দু-তিন বছরে দেশে ভূমিকম্প অনেক বেড়েছে। আবার ১০০ বছরের মধ্যে আমাদের এখানে তেমন বড় ভূমিকম্প হয়নি। এটা আতঙ্কের বিষয়। তার মানে, ছোট এসব কম্পন শক্তি সঞ্চয় করছে। ফলে সামনে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা আছে।
তুরস্কে যে ভূমিকম্প হয়েছে, এর চেয়ে ছোট, অর্থাৎ, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। কয়েক হাজার ভবন ধ্বসে পড়বে। মৃত্যু হতে পারে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষের। কারণ, আমাদের ভবনগুলো এখনও নিরাপদভাবে তৈরি হচ্ছে না।’’ বুয়েটের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে।
এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়েও উঁচু। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। অধ্যাপক আনসারী বলেন, ‘‘দ্রুত দেশের ২০ লাখ বহুতল ভবনের সবকটিকে ভূমিকম্প-সহনশীল করতে হবে। সেটা করার মতো কারিগরি দক্ষতা এবং সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে।
তবে এ জন্য সরকারের জরুরি উদ্যোগ দরকার। সারা দেশে বড় বড় শহরে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সেখানকার বাসাবাড়ি ভূমিকম্পন-সহনীয় কি না, সেটা যাচাই করতে হবে। কোনো বাসা খারাপ থাকলে মজবুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, ভূমিকম্পে ৯০ শতাংশ মানুষ মারা যায় ভবন ধসে। তুরস্কেও আমরা দেখলাম ভবন ধ্বসেই বেশি মৃত্যু হয়েছে।”
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘‘ঢাকায় যদি সাত মাত্রার ভূমিকম্পও আঘাত হানে, আমাদের যে প্রস্তুতি, ভবনের স্ট্রাকচার, ঘনবসতি তাতে অনেক বড় বিপর্যয় হতে পারে। আমাদের এত বছরে যত উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে তা আবার ফিরিয়ে আনা অনেক সময়-সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। ভূতাত্ত্বিক কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশে তিনটি টেকটনিক প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত। উত্তরে তিব্বত প্লেট, পূর্বে বার্মা সাব-প্লেট এবং পশ্চিমে ইন্ডিয়া প্লেট।
এগুলোর বিস্তৃতি সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। এই জোনে বড় বড় ভূমিকম্প হয়েছে। আবার শতবর্ষে বড় ভূমিকম্প ফিরে আসে।” বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশে ৮৭ বার ভূকম্পন হয়। এ সময় মারা যান ১৫ জন। এর মধ্যে ১৩ জনেরই মৃত্যু আতঙ্কিত হয়ে। প্রাণহানিসহ ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ শহরাঞ্চলেই বেশি। ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সারা দেশে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪৯৬ কিলোমিটার দূরের সিকিম-নেপাল সীমান্তে।
১৮৫৭ সালের পর ঢাকার এত কাছে আর কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল না। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫৭টি ভূমিকম্পের প্রভাবে কেঁপেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ২ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ভূমিকম্পে কাঁপে দেশ। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ২ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল বঙ্গোপসাগর। ২০২১ সালের ২৯ মে এক দিনেই টানা ছয় দফা মৃদু ভূমিকম্পের কারণে সিলেট শহরসহ আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসব কম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে যদি বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য উদ্ধার তৎপরতার প্রস্তুতি কেমন? ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমাদের খুব বেশি প্রস্তুতি নেই। সবচেয়ে বেশি যেটা জরুরি সমন্বিত উদ্ধার তৎপরতা, যেটার জন্য ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনওইসি) থাকতে হয়। সেটা এখন সময়ের দাবি। তবে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন করা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
যেমন ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরে আর বহুতল ভবন হবে না। পাশাপাশি যে ভবনগুলো আগে হয়েছে, সেগুলোর ভূমিকম্প-সহনশীলতাও পরীক্ষা করে নিশ্চিত করতে হবে।” তুরস্কের ভূমিকম্পের পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেছেন, ‘প্রতিটি দুর্যোগ থেকেই আমরা শিক্ষা নিচ্ছি। সে অনুযায়ী নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি।
তবে রাতারাতি সব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে ভূমিকম্প-সহনীয় দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে জাপানের সঙ্গে চার দফা বৈঠক হয়েছে। একটি সমঝোতা স্মারক তৈরি হয়েছে। সেই অনুযায়ী তিন ধাপে বাংলাদেশকে ভূমিকম্প-সহনীয় রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন