মৌলভীবাজারের রাজনগর মাথিউড়া চা বাগানের ৮ নম্বর সেকশনের স্থায়ী চা শ্রমিক ময়না রাজভর। ২০ বছর আগে গর্ভে এক সন্তান আর অবুঝ দুই শিশু রেখে স্বামী রামরুচি রাজভর চলে যান না ফেরার দেশে। এরপর থেকে স্বামীর রেখে যাওয়া ঘরেই দিন কাটছে তার।
সুবিধাবঞ্চিত চা শ্রমিক ২০ বছর আগে দৈনিক ৩২ টাকা মজুরিতে শুরু করেন জীবন সংগ্রাম। অর্ধাহার আর অনাহারের কষাঘাতে তিলে তিলে তিন অবুঝ সন্তানকে বড় করে তোলেন। পড়ালেখা শিখিয়ে তাদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও সংসারের অভাবে তা পূরণ হয়নি।
রনজিৎ, সনজিৎ ও দিলীপ এ তিন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া মাটির ঘরে ২০টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন ময়না। সন্তানরা বড় হয়েছে। তারা বাগানের বাইরে কাজ করে। সংসারের টানাপোড়েন অনেকটাই কমেছে।
ময়না স্বপ্ন দেখেন ছেলেদের বিয়ে হবে। তারা নববধূ নিয়ে এই মাটির ঘরে উঠবেন। এরপর তার জীবনটা সুখেই কেটে যাবে। তবে টাকা খরচ করে ছেলেদের বিয়ে দেয়ার সামর্থ্য যে ময়নার নেই। তার এ ইচ্ছে পূরণে এগিয়ে এসেছে শ্রমিকদের স্থানীয় সমবায় সমিতি পাতাকুঁড়ি সোসাইটি। সেখান থেকে ঋণ নিয়ে সোমবার (৮ মার্চ) একদিনে দুই ছেলের বিয়ের অয়োজন করা হচ্ছে।
ছেলেদের বিয়ে দেয়ার খবরে খুশিতে আত্মহারা ময়না। বিয়ে উপলক্ষে ঘর সাজানোর দায়িত্বটা তিনি নিজেই নিয়েছেন। সরেজমিন ময়নার ঘরে গিয়ে দেয়া যায়, বিয়ে উপলক্ষে মঙ্গলসূচক আলপনা (শ্রমিকদের ভাষায় মুগলু) আঁকছেন জীবনসংগ্রামী এই মা।
আলাপকালে ময়না তার সংগ্রামী জীবনের গল্প শোনান। জানান, ২০ বছর আগে হঠাৎ স্বামী রামরুচি মারা যান। তখন গর্ভে এক সন্তান আর কোলে অবুঝ আরও দুই শিশু। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি অকূল পাথারে পড়ে। তারপরও আঁকড়ে ধরেন স্বামীর রেখে যাওয়া মাটির ঘর ও সংসার। ৩২ টাকা দৈনিক মজুরি পেয়ে অনেক কষ্টে সংসারের হাল ধরেন। এখন তার মজুরি ১২০ টাকা হয়েছে।
কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মজুরি বৃদ্ধিতে কোনো লাভ হয়নি বলে মন্তব্য করলেন ময়না। বলেন, ‘তখন যেমন ছিলাম এখনোও তেমনি আছি। পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে ছেলেদের বড় করেছি। ছেলেরা বাগানের বাহিরে (বস্তি) কাজ করে। এখন তারা যুবক। তাই দুজনকে একসাথে বিয়ে দিচ্ছি। আমার মাটির ঘরে নববধূরা আসবে। আমার মাটির ঘর সুখে ভরবে—এমন স্বপ্নসুখ দেখছি আমি।’
ময়নার রাজভরের দু’ছেলে সনজিৎ ও রনজিৎ বলেন, ‘আমরা মায়ের কোলে বড় হয়েছি। অনেক কষ্ট করে মা আমাদের বড় করেছেন। আমরা মাকে ভুলে কোথাও যাব না।’
ময়না কেন চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের সরকারি সাহয্য পাননি, এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সত্যনাইডু বলেন, কৌশলে তাকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।
টেংরা ইউনিয়নের মাথিউড়া ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য (মেম্বার) শ্রমিক নেতা বিক্রমগৌড় বলেন, ‘স্বামী হারিয়ে তিনি অনেক কষ্ট করে সংসার ধরে রেখেছেন। বর্তমানে আমরা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে মাসে ৫০০ টাকা হারে বিধবা ভাতা প্রদান করি। তার ছেলেরা এখন কাজ করে। তিনি এখন অনেকটাই সুখী হতে চলেছেন।’
মাথিউড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক ইবাদুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী কোনো শ্রমিককে আলাদাভাবে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা করার সুযোগ নেই। চা শ্রমিকদের জীবনযাপন উন্নয়নের সরকারি সাহায্যের বিষয়টি শ্রমিক নেতারা দেখে, আমরা দেখি না।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন