কোরবানীর ঈদের সময় বিভিন্ন ধরণের মসলার চাহিদা বাড়ে। ঈদুল আজহা সামনে রেখে লাফিয়ে বাড়ছে দাম। প্রতিটি মশলাই সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে। গরম মসলার বাজার গরম। ঈদুল আজহার বাকি আর মাত্র ৩ দিন। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন দোকানীরা।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে এলাচের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে, ৫,০০০ টাকায়। দারুচিনি, জিরা, গুলমরিচের দরও বেড়েছে। সুযোগ নিচ্ছে, প্যাকেটজাত মশলা বিপণণ কোম্পানীও। এদিকে, শসা-গাজরের পাশাপাশি কাঁচামরিচ, পেঁয়াজের দামও উর্ধ্বমুখি। পোলাওয়ের চাল, চিনির বাজারেও তৈরি হয়েছে অস্থিরতা।
এই ঈদে রান্নার অন্যতম অনুষঙ্গ মসলার চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। এই সুযোগই নিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা; সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিয়েছেন দাম। প্রতি বছরের মতো এবারো কুরবানির ঈদকে ঘিরে অস্থির রাজধানীর মসলার বাজার। সরবরাহে ঘাটতি না থাকলেও প্রায় সব ধরনের মসলার দামই বাড়তি।
গত এক মাসে গরম মসলার দাম প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটসহ নানা কারণে মসলার দাম এখন নাগালের বাইরে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, কারসাজি না হলে এভাবে মসলার দাম বাড়ার কথা নয়। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের তথ্য অনুযায়ী, চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, গোলমরিচ ও জয়ত্রি।
খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা বলছেন, ঈদুল আজহা ঘিরে তিন মাস আগে থেকেই মসলা আমদানি শুরু করেন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা। এর ফলে দেশের বাজারে বিপুল পরিমাণ মসলা আমদানি হলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে প্রতিদিনই লাফিয়ে বাড়ছে দাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নানা অজুহাতে মসলার বাজারে এমন অস্থিরতা। অথচ এসব মসলা আমদানি হয়েছে তিন থেকে চার মাস আগে। আর চাহিদার বিপরীতে অতিরিক্ত আমদানি হওয়ায় এই মুহূর্তে বাজারে মসলার কোনো সংকট নেই বলে দাবি কাস্টমসের।
ভারত থেকে আমদানি কম হওয়ার অজুহাতে দুই মাস ধরেই দেশের বাজারে এলাচের দাম লাগামহীন। দুই হাজার টাকা কেজি এলাচের দাম গিয়ে ঠেকেছে ৫ হাজারে। নানা অজুহাতে অন্য মসলার দামও ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দিয়েছেন পাইকারি বিক্রেতারা।
তথ্য বলছে, মসলা ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য থাকে সারা বছরের লাভ কুরবানির ঈদ মৌসুমেই তুলে নেয়া। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় কুরবানির ঈদে গরম মসলার চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সঙ্গে পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও শুকনা মরিচের চাহিদাও বাড়ে। চাহিদা বাড়ায় ব্যবসায়ীরা আমদানিও বাড়ান। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোগানও বাড়ে। কিন্তু বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে ইচ্ছেমতো এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
এবারো তেমনটিই ঘটছে। রোজার ঈদের সময় মসলার দাম সেই যে বেড়েছে, তা এখন পর্যন্ত কমেনি। দিনে দিনে দাম কেবল বাড়ছেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির নেতা হাজী এনায়েতুল্লাহ বলেন, কুরবানির ঈদে মসলার চাহিদা বাড়ার কারণে আমদানি ও সরবরাহ বাড়াতে হয়। এ কারণে অনেক সময় বাড়তি দামেও এসব পণ্য আমদানি করতে হয়।
এবারো চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে আমদানি হয়েছে। ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই। দাম বাড়ানোর বিষয়ে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ভারতের বাজারে মসলার দাম গত বছরের মতো এবারো বাড়তি। এই প্রভাব দেশের বাজারে পড়তে পারে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবির) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বুধবার বেশ কিছু মসলার দাম বেড়েছে, কিছু মসলার দাম কমেছেও। এর মধ্যে সয়াবিন তেল (লুজ) প্রতি লিটার ২ টাকা দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৫২ টাকা।
বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারে ৫ টাকা বেড়ে ১৬০-১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজিতে ১০ টাকা দাম বেড়ে নতুন দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা এবং দেশি রসুন ২০০-২৪০ টাকা। দেশি হলুদ প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৪০ টাকা। বর্তমানে তা ৩১০-৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আমদানিকৃত আদা প্রতি কেজি ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৪০০ টাকা। প্রতি কেজি দারুচিনি বিক্রি হচ্ছে ৫২০-৬০০ টাকা, কমেছে দশমিক ৮৮ শতাংশ। এলাচ (ছোট) প্রতি কেজি ৩,৩০০-৪,০০০ টাকা, দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
ধনে প্রতি কেজি ২০০-২৭০ টাকা। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে তেজপাতার। সপ্তাহের ব্যবধানে ৪২ দশমিক ৮৬ শতাংশ দাম বেড়ে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০-৩০০ টাকা। যদিও টিসিবির এ তথ্যের চেয়ে বাজারে প্রতিটি পণ্যের দামই বাড়তি।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নানা অজুহাতে মসলার বাজারে এমন অস্থিরতা। অথচ এসব মসলা আমদানি হয়েছে তিন থেকে চার মাস আগে। আর চাহিদার বিপরীতে অতিরিক্ত আমদানি হওয়ায় এই মুহূর্তে বাজারে মসলার কোনো সংকট নেই বলে দাবি কাস্টমসের।
ভারত থেকে আমদানি কম হওয়ার অজুহাতে দুই মাস ধরেই দেশের বাজারে এলাচের দাম লাগামহীন। দুই হাজার টাকা কেজি এলাচের দাম গিয়ে ঠেকেছে ৫ হাজারে। নানা অজুহাতে অন্য মসলার দামও ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দিয়েছেন পাইকারি বিক্রেতারা। বিভিন্ন বাজারের তথ্য অনুযায়ী, দেশি পেঁয়াজের কেজি মানভেদে ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগেও ৮০ টাকা আর একমাস আগে ছিল ৬০ টাকা।
একই ভাবে গত এক সপ্তাহে প্রায় সব বাজারে রসুনের দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে এখন ২৫০ টাকা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় লাফ দিয়েছে আদার দাম। এ পণ্যটি কেজিতে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ২৪০-২৫০ টাকা।
কাওরান বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা মনিরুল ইসলাম বলেন, শুক্র-শনিবার দাম আরো বাড়বে। মনির জানান, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করলে শুল্ককরসহ দেশে আনতে প্রায় কেজিপ্রতি ৭০ টাকা খরচ হয়। যে কারণে ভারতের পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে না। এতে বাজার শুধু দেশি পেঁয়াজের ওপর নির্ভর করেই চলছে।
এক সপ্তাহ আগেও প্রতি কেজি জিরা ৬৬০-৬৮০ টাকা করে বিক্রি হলেও বর্তমানে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। কেজি প্রতি ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে শাহী জিরা। আর ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া মিষ্টি জিরার দাম কমে এখন প্রতি কেজি ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গত সপ্তাহে পাঁচফোড়ন ২২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও ঈদকে সামনে রেখে কেজি প্রতি ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে প্রতি কেজি কালো এলাচ ২ হাজার ৪৫০ থেকে ২০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৬৫০ টাকা, দারুচিনি ৩৮০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ৪২০ টাকা, লবঙ্গ ১ হাজার ৬০০ থেকে ৮০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ১ হাজার ৬৮০ টাকা এবং গোল মরিচ ৭৬০ থেকে ১০০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ৮৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া, প্রতি কেজি আদা ২০০ থেকে বেড়ে ২৭০ টাকায়, প্রতি কেজি রসুন ২৪০ থেকে বেড়ে থেকে ২৭০ টাকা এবং শুকনা মরিচ প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে বেড়ে ৪০০ টাকায় এবং গুঁড়া হলুদ প্রতি কেজি ২০০ থেকে বেড়ে টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪০০ টাকার কেজির রাঁধুনি কেজি প্রতি ২০০ টাকা বেড়ে এখন ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া মেথি ১৬০ টাকা কেজি, চিনাবাদাম ১৬০ টাকা কেজি, কাজু বাদাম ১৩০০ টাকা কেজি, পেস্তা বাদাম ৩ হাজার ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এখন দাম কমে ২ হাজার ৮০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। ত্রিফলা ১৬০ টাকা কেজি, জয়ফল ১৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও দাম কমে এখন ১ হাজার টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে।
তেজপাতা ১২০ টাকা কেজি, সাদা গোলমরিচ ১ হাজার ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও দাম কমে এখন ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ২৬০ টাকা কেজির ধনিয়া কেজি প্রতি দাম কমে ১৮০ টাকা, ১৪০ টাকা কেজির সরিষা দাম কমে ১০০ টাকায়, ৮০০ টাকা কেজি দরের কিশমিশ কেজি প্রতি প্রায় ২০০ টাকা কমে ৫০০ থেকে ৫২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
২ হাজার ৬০০ টাকা কেজির গোল্ডেন এলাচ কেজি প্রতি ২৮০০ টাকা, ২৬০০ টাকা কেজি দরের বড় এলাচ কেজি প্রতি ২০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৮০০ টাকা, গোলমরিচ ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন দাম কমে ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খিলগাঁও কাঁচা বাজারের মসলা বিক্রেতা জামিলউদ্দিন বলেন, ঈদুল আজহায় সবাই যেহেতু কুরবানি করে সেহেতু মসলার চাহিদা বেশি থাকে। ইতোমধ্যে ক্রেতারা মসলা কেনা শুরু করে দিয়েছেন। আগামী দুই-তিন দিন প্রচুর মসলা বিক্রি হবে। একই বাজারের আরেক মসলা বিক্রেতা আমির আলী বলেন, মসলার দাম কমলেও ক্রেতাদের সন্তুষ্টি দেখি না। সব মসলায় নাকি দাম। আমাদের হাতে তো দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই। যারা দাম নিয়ন্ত্রণ করে তাদের উদ্যোগ নিতে হবে।
মালিবাগ রেলগেট কাঁচা বাজারে মসলা কিনতে আসা সুরাইয়া ইসলাম বলেন, ঈদে আমি গরু কুরবানি করি। খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেক মাংস থাকে। মসলারও প্রয়োজন হয় প্রচুর। কিন্তু বাজারে এসে দেখি সব মসলারই দাম বেশি। ৫০০ টাকা কেজি মসলার দাম যদি কেজি প্রতি ২ হাজার টাকা বাড়িয়ে একমাস পর ২০০ টাকা কমায়, তাহলে কি তাকে কম বলা যায়? এগুলো তো সিন্ডিকেট ব্যবসা।
আরিফুর রহমান নামে আরেক ক্রেতা বলেন, প্রতি বছরই মসলা কিনতে হয়। শুনেছিলাম এবার নাকি মসলার দাম কম। কিন্তু বাজারে এসে দেখি কিছুই কম নেই। দাম আগের মতোই চড়া। মানুষের আইওয়াশ করার মতো দাম কমিয়ে লাভ নেই। ঈদ সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে সম্প্রতি মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এসময় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, দাম বাড়ার কথা না থাকলেও অযৌক্তিকভাবে বাজারে কারসাজি করে কিছু পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। গত রোজায় দেখা গেছে, কিছু পণ্যের চাহিদাকে পুঁজি করে বাজার অস্থির করে রাখা হয়েছিল। এবার কেউ অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
সভায় বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনায়েত উল্লাহ বলেন, পণ্য আমদানিতে বিভিন্ন স্তরে শুল্ক দিয়ে দাম বাড়ায় এনবিআর। এরপর মার্কেটে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে আমাদের পেছনে ম্যাজিস্ট্রেট লাগিয়ে দেয়া হয়, জরিমানা করা হয়। তদারকি সংস্থার উদ্দেশে তিনি বলেন, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ব্যবসায়ীদের লাঞ্ছিত করছেন। জায়গায় জায়গায় অপদস্থ করাচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই উচিত নয়।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন