সমাজের প্রাকৃতিক আনন্দ ‘মোবাইল’ এ বন্দি

সমাজের প্রাকৃতিক আনন্দ ‘মোবাইল’ এ বন্দি

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ খাল, এ দেশে এমন এলাকা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর বিল, নদী, নালা, হাওর-বাওর নেই যদিও তা আগের তুলনায় কমে গেছে। এগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ, এসবের উপর ভর করে এক শ্রেণীর মানুষের গোটা জীবন চলে। মাছ ছাড়াও অন্যান্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে শামুক, ঝিনুক, শাপলা, শালুক, সিঙ্গারা সহ বৈচিত্র্যময় অসংখ্য অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ।

এক কথায় বলা চলে এসব প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো নিরাপদ খাদ্যের এক একটি বিশাল ভাণ্ডার। এ দেশের জলাশয়গুলোতে বর্ষার শুরুতে বৈচিত্র্যময় মাছের প্রজনন ঘটে। গোটা জলাশয়ে এসব মাছ বিচরণ করে এবং প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠে। বর্ষা মৌসুম শেষে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর কম গভীরতার নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর-বাওর পানি শুকিয়ে হাঁটু বা কোমর পর্যন্ত নেমে আসে। তখন গ্রাম বাংলায় বেশ কিছু উৎসব হয় জলাশয়গুলো থেকে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে।

এর মধ্যে আছে হাঁটু পানিতে হাত দিয়ে মাছ ধরা, বড়শি ঝাঁকি জাল, ঠেলা ও টানা জাল,বেড় জাল, দোয়াইর, ভেসাল ও পলো। বেড়জাল ও ভেসাল দিয়ে মূলত জেলে সম্প্রদায় মাছ শিকার করে থাকে থাকে। বেড়জাল বা ভেসাল জাল দিয়ে মাছ ধরা একসময় মৎস্যজীবীদের প্রধান জীবিকার মাধ্যম ছিল। বর্ষাকালে খালে জলপ্রবাহ থাকত, যা মাছ ধরার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করত।

কিন্তু নাব্যতা হারানোর ফলে আজকাল খালগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে এবং অনেক জায়গায় খালের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে গেছে। এতে করে এই মাছ ধরার পদ্ধতিও হারিয়ে যেতে বসেছে। তাছাড়া উৎসবমুখর পরিবেশে আর একটা মাছ ধরা পদ্ধতি হল যা প্রতিটি স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকে। পলো উৎসবটি অনুষ্ঠানের জন্য এলাকার (কয়েকটি গ্রাম বা উপজেলার লোক হতে পারে) পলো শিকারিরা প্রতিটি গ্রামের পলো শিকারিদের মুখে মুখে প্রচার করে পলো বাওয়া উৎসবের নির্দিষ্ট দিন ও ক্ষণ জানিয়ে দেয়।

নির্ধারিত দিনে বিভিন্ন উপজেলা ও গ্রামের পলো শিকারিরা নিজ নিজ পলো নিয়ে নির্দিষ্ট জলাশয়ে উপস্থিত হয় এবং ভাটি থেকে উজানের দিকে সারিবদ্ধভাবে পলো ফেলতে ফেলতে অগ্রসর হয়। এসময় শিকারিরা পরস্পরকে উৎসাহিত করতে জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে ডাক ভাঙতে থাকে। পলো ফেলার শব্দ ও মানুষের চিৎকারে পানিতে থাকা মাছগুলো আতঙ্কিত হয়ে লাফালাফি করলে মাছগুলো লক্ষ্য করে পলো দিয়ে সেগুলো আটকে ধরা হয়।

পলো বাওয়া একটি কঠিন কাজ এবং এর জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়, দুর্বল ও কম শক্তির লোক এতে অংশগ্রহণ করতে পারেনা। যেহেতু কোমর পানি ভাঙতে হয় এবং দলের সাথে এক সাড়িতে অগ্রসর হয়ে পলো ফেলতে ফেলতে এগোতে হয় তাই এক্ষেত্রে পলো শিকারির অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়। পানিতে পলোর ওজন বেড়ে যাওয়ায় এবং ঘন ঘন পলো উঠিয়ে পানিতে ফেলা অনেক কষ্টকর।

অন্যদিকে একজন শিকারি যদি সারি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পিছিয়ে পড়ে তাহলে মাছগুলো সেই ফাঁক দিয়ে শিকারিদের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়।বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ছেলেরা ঘরকোনা হয়ে যাওয়ার ফলে নিজেরা হাত দিয়ে মাছ ধরা এখন তাদের সম্ভব হয় না, এছাড়া বহু অঞ্চলে বর্ষায় পর্যাপ্ত পানি না হওয়াও বড় কারণ।

তাছাড়া আমরা যারা নব্বই দশক কিংবা তারও আগে পরে শৈশব অতিক্রম করেছি, সেই সময়ে সামাজিক বন্ধন বেশ মজবুত ছিল। পুরো পাড়া মহল্লার সকলেই একই পরিবারের মতো থাকতো। ফলে সবাই মিলেই উপভোগ করা হতো সবকিছু। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো বর্ষা ও বর্ষা শেষে মাছ ধরার পরিবেশ থাকলেও বিভিন্ন অঞ্চলে এখন আর সেই দিন নেই, কোন কোন এলাকায় একেবারেই নেই। সবকিছু মোবাইল বন্দী হয়ে গেছে। সমাজের প্রাকৃতিক আনন্দ ‘মোবাইল’ এ বন্দি এই মাছ কে উপলক্ষ্য করে সমাজের কিছু চিত্র ফুটে উঠেছে গানে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password