বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী রোগ সেপসিস

বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী রোগ সেপসিস
MostPlay

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী একটি বড় অংশে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদূষণজনিত প্রাণঘাতী সেপসিস রোগ। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা সংলগ্ন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট, দেগঙ্গা ,সন্দেশখালি, হাড়োয়া অঞ্চলে অন্তত ছয় শতাধিক সেপসিস আক্রান্তকে ইতিমধ্যেই শনাক্ত করা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা আরো বহুগুণে বেশি।ইতিমধ্যেই আক্রান্তদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে প্রশাসন।

বিশ্বজুড়ে পাঁচজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু প্রাণঘাতী রক্তরোগ সেপসিসের (রক্তদূষণ) কারণে ঘটে, এটি রক্তের বিষ হিসেবেও পরিচিত। এই রোগটি সম্পর্কে এ যাবতকালের সবচেয়ে ব্যাপক বিশ্লেষণ হয়েছে। সেপসিস ‘গুপ্ত ঘাতক’ হিসেবেও পরিচিত কারণ এটি শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে।

মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অতিরিক্ত কাজ করার ফলে এই সেপসিস হতে পারে। এই প্রতিরোধ ক্ষমতা কেবল সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে শরীরের অন্যান্য অংশগুলোতেও আক্রমণ শুরু করে। এক পর্যায়ে মানুষের অঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। এমনকি বেঁচে থাকা মানুষদেরও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি ও অক্ষমতা নিয়ে চলতে হতে পারে।

যেসব ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া সংক্রমণ বা ফুসফুসের রোগ হয়ে থাকে সেগুলোই সেপসিস হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। বছরে এক কোটি ১০ লাখ মানুষ সেপসিসে মারা যাচ্ছে - যে সংখ্যা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যার চাইতেও বেশি। গত সেপ্টেম্বর মাসে এই রোগের সর্বপ্রথম প্রভাব দেখা যায় দেগঙ্গা এলাকায়।

দেগঙ্গায় ইতিমধ্যেই মারা গেছেন দুজন আক্রান্ত। সব মিলিয়ে এই এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা কমপক্ষে তিন শ। আক্রান্ত এবং মৃতদের মধ্যে রক্ত জমাট বাধার লক্ষণ থাকায় স্থানীয়রা প্রাথমিকভাবে এই রোগে আক্রান্তদের সাপে কাটা রোগী বলে চিহ্নিত করেন। এবং হাসপাতালের বদলে রোগীদের স্থানীয় ও ওঝার মাধ্যমে সুস্থ করার চেষ্টা করেন।

পরবর্তীতে প্রশাসন ও বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদী মঞ্চের সদস্যরা আক্রান্তদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে আক্রান্তদের প্রকৃত রোগের কারণ জানতে পারেন। দেগঙ্গা থেকে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ধীরে ধীরে এই রোগের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বসিরহাট, হাড়োয়া , সন্দেশখালির বিস্তীর্ণ এলাকায়। এই তিন এলাকায় এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।

তারা হলেন বসিরহাটের বাদুড়িয়া ব্লকের কাটিয়াহাট গ্রামের তারভান বিবি, সন্দেশখালি ২নং ব্লকের জেলিয়াখালির বাসিন্দা রহিলা বিবি ও হাড়োয়া ব্লকের খাসবালান্দা গ্রাম পঞ্চায়েতের খাড়ুবালার বাসিন্দা রহমান মোল্লা। এরা প্রত্যেকেই কলকাতার বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালে তাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে সেপসিসের উল্লেখ করা হয়।

এরপর এই রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এসব এলাকায়। বসিরহাটের তারভান বিবির ছেলে মোহাম্মদ আনারুল গাজী এবং পুত্রবধূ বলেন আচমকাই পেট ব্যথা ,পাতলা পায়খানা সঙ্গে বমি শুরু হলে তারভান বিবিকে স্থানীয় ব্লক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা দীর্ঘ সময় ভর্তি রাখলেও রোগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়ে কলকাতার বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা পরামর্শ দেয়। সেখানে এইমাত্র ২৪ ঘন্টা চিকিৎসাধীন থাকার পরেই মৃত্যু হয় তার।

বসিরহাট ১ নম্বর ব্লকের ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসের জয়দীপ চক্রবর্তী বলেন একেবারে গ্রামীণ সীমান্ত এলাকা। মানুষের শিক্ষার হার এই এলাকায় কিছুটা কম। অনেকেরই ধারণা যে তাদের কিছু কামড়িয়েছে অনেকেই বলছেন সাপে কামড়েছে। অনেকেই ওঝার কাছে চিকিৎসা করাচ্ছেন ফলে চিকিৎসা পেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমরা গ্রামবাসীদের বোঝাচ্ছি ,মাইকিং করছি। ধীরে ধীরে সবাই চিকিৎসা নিতে আসছেন। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যরা মাঠ পর্যায়ে মানুষকে বোঝানোর কাজ করছেন।

১৯৫ টি দেশের মেডিকেল রেকর্ডের ভিত্তিতে ল্যানসেটে প্রকাশিত এই বিশ্লেষণে দেখা যায় যে বছরে চার কোটি ৯০ লাখ মানুষ সেপসিসে আক্রান্ত হয়। সেপসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এক কোটি দশ লাখ মানুষ। বিশ্বজুড়ে বছরে যতো মানুষ মারা যান, তাদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের মৃত্যুর কারণ এই সেপসিস। পাঁচ বছরের কম বয়সী ১০জন শিশুর মধ্যে চারজনের সেপসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।প্রতি বছর যুক্তরাজ্যে সেপসিসের কারণে প্রায় ৪৮ হাজার মানুষ মারা যান।

এমন রোগ বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশেও এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। শরীরের যে কোনও অঙ্গের সংক্রমণ (ইনফেকশন) সেপসিসের আকার ধারণ করতে পারে। ফুসফুস, কিডনি, খাদ্যনালি বা অন্য যে কোনও অঙ্গের সংক্রমণ যখন রক্তে প্রবেশ করে, তখন তাকে বলা হয় সেপ্টিসেমিয়া। যেমন কোনও ব্যক্তির ফুসফুসের সংক্রমণ বলতে নিউমোনিয়া বোঝানো হয়। ফুসফুসের সংক্রমণ যদি রক্তে প্রবেশ করে, তখন সেটি সেপ্টিসেমিয়া। এর কারণে দেহে যে ক্রিয়া-বিক্রিয়া শুরু হয়, তার ফলে অন্যান্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এমনকি এর জেরে একাধিক অঙ্গ অকেজো হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। এই অবস্থাকে বলা হয় সেপসিস। সেপসিসের লক্ষণ গুলি হলো অস্পষ্ট কথা, চরম কাঁপুনি বা পেশী ব্যাথা, চেতনা হ্রাস, সারাদিনে কোনও প্রস্রাব না হওয়া, শ্বাসকষ্ট, দ্রুত হৃৎস্পন্দন এবং শরীরের তাপমাত্রা অনেক বা কম হওয়া। ত্বকের রং একেক জায়গায় একেক রকম বা ছোপ ছোপ দাগ। শিশুদের ক্ষেত্রে চেহারা দেখতে নীলচে বা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া। হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়া বা খিঁচুনি।ত্বকে ফুসকুড়ি।

তবে সেপসিস প্রতিরোধের উপায় হল, সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি এবং সঠিক সময় সঠিক টিকার যোগান। দেরি হওয়ার আগেই সেপসিস আক্রান্ত রোগীদের ভালভাবে চিহ্নিত করা। এবং দ্রুত তাদের চিকিৎসা শুরু করা। অ্যান্টিবায়োটিক্স বা অ্যান্টি-ভাইরাসের মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password