৯/১১ হামলা ও একটি কালো অধ্যায়

৯/১১ হামলা ও একটি কালো অধ্যায়
MostPlay

আজ ৯ সেপ্টেম্বর। আমেরিকার ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। বলা হয়, ৯/১১ বিশ্বকেই বদলে দিয়েছে। ৯/১১ এর আগের বিশ্ব এবং ৯/১১ পরবর্তী বিশ্বের তফাতটা অত্যন্ত পরিষ্কার।  মাত্র ১৯ জন ছিনতাইকারী ৪টি বিমান ছিনতাই করে সেগুলোকে গাইডেড মিসাইল বা নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রে পরিণত করে। যার দ্বারা বিশ্বকে এক ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি করে।

সেই ভয়াল দিনঃ

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। সকালটা দারুণ। আর আবহাওয়া ছিল চমৎকার। মানুষ ধীরে ধীরে কর্মস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন। সকাল ৮:৪৫ মিনিটে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৬৭ বিমানটি প্রায় বিশ হাজার গ্যালন জেট ফুয়েল নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নর্থ টাওয়ারে আঘাত করে। এটি ছিল ১১০ তলা ভবন যার ৮০তম তলায় বিমান আঘাত করে। মুহূর্তের মধ্যে কয়েকশ মানুষ মারা যায়। বহু মানুষ আটকা পড়ে ওপরের তলাগুলোতে। এই ভবন এবং টুইন টাওয়ারের অপর ভবন সাউথ টাওয়ার থেকে লোকজন সরিয়ে নেয়া শুরু হয়। আর টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও তৎক্ষণাৎ সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে দেয়।

প্রথমে মনে করা হয়েছিল এটি কোন মাতালের কান্ড। কিন্তু ১৮ মিনিটের মাথায় ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের আরেকটি বিমান সাউথ টাওয়ারের ৬০তম তলায় ঢুকে পড়ে। প্রচন্ড বিস্ফোরণ হয়, ভবনের বিভিন্ন অংশ খন্ড-বিখন্ড হয়ে আশপাশের ভবনগুলোর ওপর ছড়িয়ে পড়ে। তখনই প্রথম বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ শুরু হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ঠিক কেন্দ্রে এই হামলার ২০ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের সাউথ টাওয়ারটি ধ্বসে পড়ে। ধূলা আর ধোঁয়ার মেঘ তৈরি হয় সেখানে। আশেপাশের এক ডজনের বেশি স্থাপনা ধ্বংস হয় বা মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের টাওয়ার দু’টির কাঠামো তৈরি  হয়েছিল মজবুত ইস্পাতে, যা ঘন্টায় ২০০ মাইল বেগের বায়ু প্রবাহ, এমন কি বড় মাত্রায় অগ্নিকান্ড সহ্য করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু জেট ফুয়েল সৃষ্ট উত্তাপ সামলে নিতে পারেনি ইস্পাতের এই কাঠামোটি। সকাল ১০:৩০ মিনিটে ধ্বসে পড়ে অপর টাওয়ারটিও। উদ্ধারকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন ভবনটির ওপরের তলাগুলো থেকে লোকজনকে উদ্ধার করতে। কিন্তু আগুনের উত্তাপে বহু উদ্ধারকর্মী মারা যান।

অসংখ্য মানুষ যখন টুইন টাওয়ার হামলার ওপর চোখ সেঁটে রেখেছেন তখনই ৯:৪৫ মিনিটে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের আরেকটি বিমান বোয়িং-৭৫৭ আঘাত করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সদরদপ্তর পেন্টাগনের পশ্চিম অংশে। এখানেও বিপর্যয়ের কারণ ছিল জেট ফুয়েল। পেন্টাগনের ১২৫ জন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তি মারা যান, সাথে বিমানে থাকা ৬৪ জন আরোহীরাও মারা যান।

নিউজার্সির বিমানবন্দর থেকে চতুর্থ বিমানটি উড়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে। ৪০ মিনিটের মধ্যেই বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। কিন্তু বিমানটি যাত্রা করেছিল নির্ধারিত সময়ে চেয়ে দেরিতে। টেলিফোন আলাপে অনেক যাত্রীই জেনে যান টুইন টাওয়ারে হামলার বিষয়টি। বিমানটি ছিনতাইয়ের পর যাত্রীরা বুঝতে পারেন কি হতে চলেছে। কয়েকজন যাত্রী অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে ককপিটে হামলা করেন, বাধা দেন ছিনতাইকারীদের। ১০:১০ মিনিটে পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে আছড়ে পড়ে বিমানটি। হামলাকারীরা বিমানটিকে আসলে কোথায় নিতে চেয়েছিল সেটি পরিষ্কার নয়। মনে করা হয় হোয়াইট হাউজ, মেরিল্যান্ডে প্রেসিডেন্সের অবকাশ যাপন কেন্দ্র ‘ক্যাম্প ডেভিড’ কিংবা পশ্চিম উপকূলে থাকা কয়েকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোন একটি ছিল তাদের লক্ষ্য।

যাত্রীবাহী বিমান যে কারণে ধ্বংসাত্নকঃ

সামরিক বিমান বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক বহন করে, ফলে সেটির আঘাতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। কিন্তু যাত্রীবাহী বিমানে কোন বিস্ফোরক থাকে না। তবু মাত্র দু’টি বিমানের আঘাতই ১১০ তলা ভবন দু’টিতে ধ্বংস সৃষ্টি করেছিল। বিমানগুলো সেসময় জ্বালানি ভর্তি ছিল। বিপুল পরিমাণ জ্বালানিই ছিল বড় মাত্রায় বিস্ফোরণের জন্য দায়ী। আর এ বিস্ফোরণের ফলে ভবন দু’টো ধ্বসে পড়ে, বিমানের আঘাতে নয়।

১৯ জন আত্নঘাতী হামলাকারী এবং ৪টি বিমানঃ

৪টি বিমানের দু’টির লক্ষ্য ছিল নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর ও দক্ষিণ টাওয়ার। অন্য একটি আঘাত করে পেন্টাগনে, যেটির অবস্থান ওয়াশিংটনের ঠিক বাইরেই আর চতুর্থ বিমানটি আছড়ে পড়ে পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে।

 প্রাণহানিঃ

এই হামলায় তিন হাজারের মত লোক মারা যায়। যাদের মধ্যে চারশ’র বেশি ছিলেন পুলিশ এবং অগ্নিনির্বাপণ কর্মী। যুক্তরাষ্ট্রের অগ্নিনির্বাপণকর্মীদের জন্য ইতিহাসের ভয়াবহতম দিন ছিল এটি। একদিনেই মারা যায় ৩৪৩ জন। দশ হাজারের মত লোক আহত হয়, যাদের অনেকের অবস্থাই ছিল গুরুতর।

ভবনটির নকশায় কোন ত্রুটি ছিল নাঃ

তদন্ত শেষে বলা হয় ভবনটির নকশায় কোন ত্রুটি ছিল না। এ ধরনের হামলার ঘটনা নজিরবিহীন। শত শত মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয় স্থানটি খালি করতে। ভবনটির কাঠামো ছিল ‘টিউব ইন টিউব’ পদ্ধতির। প্রতি তলায় জায়গা বাড়ানোর জন্য বাইরের দিকে বেশি পরিমাণে কলাম দেয়া হয়। আর ফ্লোর গুলোয় বেশি পরিমাণে বিম দেয়া হয়।  বিমানের আঘাতের পর বিস্ফোরণ স্থলের ওপর ভবনের ওপরের অংশ ধ্বসে পড়ে, প্রচন্ত উত্তাপে ইস্পাত গলে যায়। ওপরের চাপ নিতে না পেরে ভবন দু’টো নিচের দিকে ধ্বসে পড়ে।

প্রেসিডেন্টের যুদ্ধ যোষণাঃ

এ হামলা প্রচন্ড উদ্বেগ তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রে। নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশকে সারা দিনই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়। সন্ধ্যা সাতটায় হোয়াইট হাউজে ফেরেন তিনি। রাত নয়টায় দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন।

ভাষণে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, সন্ত্রাসীরা আমাদের সর্বোচ্চ ভবনগুলোর ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিত কাঁপাতে পারে নি। এসব কর্মকান্ড ইস্পাত গলিয়ে দিতে পারে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ়তায় যে ইস্পাত রয়েছে তাকে নয়”।

সামরিক পদক্ষেপ প্রসঙ্গে জুনিয়র বুশ বলেছিলেন, “যারা সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত তারা এবং যারা সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেয় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের মধ্যে কোন তফাত নেই”। যুক্তরাষ্ট্র তার ভাষায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী এক যুদ্ধ শুরু করে।

হামলার উদ্দেশ্যঃ

১৯ জন হামলাকারীরা ছিলেন সৌদি আরব এবং অন্য কয়েকটি আরব দেশের নাগরিক। বলা হয়ে থাকে, সে সময়ের পলাতক ওসামা বিন লাদেন এ হামলার জন্য অর্থায়ন করেছিলেন।

ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন, পারস্য উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সামরিক উপস্থিতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে সংশ্লিষ্টরা এ হামলা চালিয়েছিলেন বলে বলা হয়।

হামলার পরিকল্পনা এবং পূর্ব উপকূল থেকে যাত্রাঃ

হামলাকারীদের কয়েকজন এক বছরের বেশি সময় যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছেন এবং কয়েকটি বাণিজ্যিক ফ্লাইং একাডেমী থেকে বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বাকি কয়েকজন হামলার কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। তাদের কাজ ছিল হামলাকারীদের শক্তিবৃদ্ধি করা। তারা সহজেই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে বক্স কাটার এবং ছুরি নিয়ে বিমানে উঠতে সক্ষম হন। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলীয় তিনটি বিমানবন্দর থেকে ক্যালিফোর্নিয়াগামী চারটি বিমানে চেপে বসেন তারা। গন্তব্য হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়াকে বেছে নেয়ার কারণ একটাই দীর্ঘ যাত্রার জন্য জ্বালানিপূর্ণ থাকে এসব বিমান।

 সাংকেতিক বার্তাঃ

ধারণা করা হয় ৯/১১ হামলায় অংশগ্রহণকারীরা সাংকেতিক বার্তার মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করত। হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে আবু আবদুর রহমান নামের এক পরিকল্পনাকারী তার বান্ধবীকে এমনই এক বার্তা পাঠিয়েছিল। তিনি লেখেন, ৩ সপ্তাহের মধ্যে প্রথম সেমিস্টার শুরু হবে। দুটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (টুইন টাওয়ার) এবং দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ( ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত লক্ষ্যবস্তু)…এ গ্রীষ্মে নিশ্চিতভাবে অনেক গরম পড়বে… ব্যক্তিগত পড়াশোনায় ১৯টি সনদপত্র (হামলায় অংশগ্রহণকারী হাইজ্যাকারদের সংখ্যা) এবং ৪টি পরীক্ষা (হামলায় ব্যবহৃত বিমান)। অধ্যাপককে আমার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। বিদায়।

 আগুন জ্বলেছিল ৯৯ দিনঃ

হামলার পর ঘটনাস্থলে এক মাস ধরে আগুন জ্বলেছিল। তবে কেউ কেউ জানান, হামলার ৯৯ দিন পর পর্যন্ত আগুন জ্বলার প্রমাণ রয়েছে। তারা জানান এ আগুন ২০০১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত জ্বলেছিল।

 ২০ ভাগ্যবানঃ

হামলার পর ঘটনাস্থল থেকে জীবিত উদ্ধারের সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত আছে। তবে অধিকাংশের মতে, হামলার পর উদ্ধারকৃতদের মধ্যে মাত্র ২০ জন শেষ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তবে এরা বাকি জীবন শরীরের বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনার ক্ষত বয়ে বেড়িয়েছিলেন।

 আশ্চর্য ইঞ্জিনঃ

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট একাডেমি জানিয়েছে, টুইন টাওয়ারে হামলার পর ব্যবহৃত বিমানের মাত্র ১টি ইঞ্জিন উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। টুইন টাওয়ার হামলায় বিস্ফোরণ এবং সৃষ্ট তাপে ইঞ্জিনটির টিকে থাকা এখনও রহস্যজনক।

 আত্মঘাতী হামলাকারীঃ

৯/১১ হামলার জন্য অভিযুক্তদের অনেকেই এখনও জীবিত রয়েছেন মাঝে মাঝে খবর পাওয়া যায়। এ নিয়ে হামলার পরপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল বিবিসি এবং দ্য গার্ডিয়ান। সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হল, অভিযুক্তদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

 ৯/১১ হামলা ও মুসলিমদের উপর দোষারোপঃ

৯/১১ ঘটনার অজুহাতে স্বাধীন দুটি দেশ ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণ করা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। লাখো মানুষকে উদ্বাস্তু বানানো হয়েছে। দেশ দুটিকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে নিদেনপক্ষে একশ বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর কালিমা লেপন করা হয়েছে। ৯/১১ ঘটনার আগ পর্যন্ত ইসলাম ও মুহাম্মদ (সাঃ)-কে সাধারণ অমুসলিমরা কখনোই এতটা ঘৃণার চোখে দেখত না।

অথচ ৯/১১ ঘটনার পর থেকে ইসলামকে একটি “সন্ত্রাসী ধর্ম” আর মুসলিম মানেই “সন্ত্রাসী” বা “জঙ্গী” বা খারাপ অর্থে “মৌলবাদী’ বলে সন্দেহ করা শুরু হয়। কোথাও সন্ত্রাসী হামলা হওয়ার সাথে সাথে কোনো রকম তদন্ত ছাড়াই ইসলাম ও মুসলিমদের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ৯/১১ তাহলে ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য আশির্বাদ নাকি অভিশাপ? অন্যদিকে ৯/১১’র মতো ঘটনার দ্বারা কারা লাভবান হয়েছে?

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password