বোনের প্রেমিককে বিয়ে করেন প্রিন্সেস ডায়ানা, মৃত্যুর পরও পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক

বোনের প্রেমিককে বিয়ে করেন প্রিন্সেস ডায়ানা, মৃত্যুর পরও পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক
MostPlay

মৃত্যুর ২৩ বছর পরও বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না লেডি ডায়ানার। সম্প্রতি ফের আলোচনার কেন্দ্রে অতীতের ব্রিটিশ যুবরানির একটি সাক্ষাৎকার। সেই সাক্ষাৎকার তিনি দিয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে বিবিসিকে।বিবিসি-র জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘প্যানোরমা’-র জন্য ডায়ানার সেই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মার্টিন বশির। ১৯৯৫ সালে সম্প্রচারিত সেই সাক্ষাৎকারে ডায়ানা বলেছিলেন যুবরাজ চার্লসের সঙ্গে ভেঙে পড়া তার দাম্পত্যের কথা।

ডায়ানার কথায় উঠে এসেছিল চার্লসের সঙ্গে ক্যামিলা পার্কারের দীর্ঘ প্রেমের কথা। পাশাপাশি ডায়ানা এও স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি চার্লসের পাশাপাশি অন্য পুরুষের সঙ্গেও প্রণয়ে লিপ্ত।ষোড়শী ডায়ানাকে প্রথমবার চার্লস দেখেছিলেন ১৯৭৭ সালে। তখন ডায়ানার বোন লেডি সারার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল চার্লসের। কিন্তু ডায়ানার সঙ্গে আলাপের পর থেকে ঘুরে যায় প্রেমের অভিমুখ।

৪ বছর প্রেমপর্বের পর ১৯৮১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাগদান। নিজের এনগেজমেন্ট রিং নিজেই পছন্দ করেছিলেন ডায়ানা। বাগদানের ৪ মাস পর বিয়ে। চার্লস-ডায়ানার রূপকথাসম সেই বিয়ে হয়েছিল ১৯৮১ সালের ২৯ জুলাই, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে।ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যরা সাধারণত বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়েন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে। কিন্তু চার্লস-ডায়ানার বেলায় সেই রীতি ভাঙা হয়েছিল। কারণ, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের তুলনায় সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে দর্শকাসন অনেক বেশি ছিল।

কিন্তু ব্রিটিশ যুবরাজের বিয়ের আসরে তো নিমন্ত্রিত হিসেবে থাকার সৌভাগ্য মুষ্টিমেয় অভ্যাগতদেরই হয়। নববিবাহিতদের দেখার জন্য রাজপথে দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলেন ৬ লাখ দর্শক। সারা পৃথিবীতে এই রাজকীয় বিয়ে দূরদর্শনের পর্দায় দেখেছিলেন ৭৫ কোটি দর্শক।সেই বিয়ের ১৬ বছর পর বিবিসি-তে ডায়ানার বিস্ফোরক সেই সাক্ষাৎকারের দর্শকও সেই সময়ের নিরিখে ছিল রেকর্ড সংখ্যক। ২ কোটি ২৮ লাখ দর্শক শুনেছিলেন যেখানে ডায়ানা বলেছিলেন তার রূপকথার মতো দাম্পত্যে কীভাবে ঘুণ ধরেছিল।

মাত্র ৩৬ বসন্তের জীবনে আভিজাত্য ও জনপ্রিয়তা সবসময়েই সঙ্গী ছিল লেডি ডায়ানার। ১৯৬১ সালের ১ জুলাই তার জন্ম নরফোকের বিখ্যাত স্পেনসার পরিবারে। বংশপরম্পরায় তারা ছিলেন আর্ল। ব্রিটিশ রাজপরিবারের সঙ্গে এই অভিজাত বংশের সুসম্পর্কও বহু দশকের প্রাচীন।বয়সে ১৩ বছরের বড় যুবরাজ চার্লসকে বিয়ের পর ডায়ানার উপাধি হয় ‘প্রিন্সেস অব ওয়েলস’। বিয়ের আগে শিক্ষিকার চাকরি করতেন। সেটি ডায়ানা ছেড়ে দেন বিয়ের সময়।

বিয়ের পরের বছর ২১ জুন জন্ম হয় চার্লস-ডায়ানার বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়ামের। তার ২ বছর পর ১৯৮৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মা নেন প্রিন্স হ্যারি। রাজপরিবারের লালফিতার ফাঁসের বাইরে ছেলেদের বড় করতে চেয়েছিলেন ডায়ানা।

ছেলেদের প্রথম নাম থেকে তারা কোন স্কুলে পড়বে— সব সিদ্ধান্ত ছিল তারই। যখনই সময় পেতেন, প্রোটোকল ভেঙে নিজেই যেতেন ছেলেদের স্কুলে। প্রয়াস ছিল, সন্তানদের খোলা হাওয়ার পরিবেশে বড় করতে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের কারণে ডায়ানার ছোটবেলা ছিল বিধ্বস্ত। তাই তিনি নিজের সন্তানদের একটা সু্স্থ, স্বাভাবিক শৈশব দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আরও অনেক ইচ্ছের মতো ডায়ানার এই স্বপ্নও অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

ডায়ানা নিজেও পছন্দ করতেন রাজপরিবারের লাল ফিতার ফাঁসের বাইরে উন্মুক্ত পরিবেশ। নিজের জন্মভূমি ও বিশ্ববাসীর ভালবাসা পেলেও ব্রিটিশ রাজপরিবারের সঙ্গে তার দূরত্ব ক্রমেই বেড়েছে।বিয়ের ৫ বছর পর থেকেই প্রকাশ্যে চলে আসে চার্লস-ডায়ানা সম্পর্কের শৈত্য। প্রাক্তন বান্ধবী ক্যামিলা পার্কারের সঙ্গে চার্লসের সম্পর্ক নতুন করে গাঢ় হয়। অন্যদিকে ডায়ানার নাম জড়িয়ে যায় মেজর জেমস হেউইটের সঙ্গে।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ক্যাভালরি অফিসার হেউইট ছিলেন রাজপরিবারের রাইডিং অফিসার। যুবরানির সঙ্গে সম্পর্কের কথা তিনি নিজেও স্বীকার করেছিলেন। ব্রিটিশ ট্যাবলেয়েডে এই সন্দেহও প্রকাশ করা হয় যে প্রিন্স হ্যারির জন্মদাতা আসলে হেউইট! কারণ দু’জনের চেহারার সাদৃশ্য।

অভিযোগ অস্বীকার করে হেউইট জানান, হ্যারির জন্মের ২ বছর পর তার এবং ডায়ানার সম্পর্ক শুরু হয়। এখানেই শেষ নয়। শিল্পসামগ্রীর ডিলার প্রয়াত অলিভার হোয়ারের সঙ্গেও ডায়ানার প্রেম নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়। তবে এই সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে ডায়ানার দাবি ছিল, অলিভার আর তিনি ছিলেন শুধুই ভাল বন্ধু। পরবর্তীতে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি হার্ট সার্জন হাসনাত খানের সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন ডায়ানা।

অন্যদিকে, ডায়ানা তার বিয়ে ভাঙার জন্য আঙুল তুলেছিলেন ক্যামিলা পার্কারের দিকে। পাশাপাশি, একাধিক সম্পর্কে চার্লস লিপ্ত ছিলেন বলেও ইঙ্গিত করেন ডায়ানা। এই টানাপোড়েনের পাশাপাশি বিবিসিকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে ডায়ানা অকপটে স্বীকার করেছিলেন তার মানসিক সমস্যার কথা।

বলেছিলেন, তিনি নিজেই নিজেকে আঘাত করতেন। তার এই মানসিক দ্বন্দ্বের কথা সমর্থন করেছিল ঘনিষ্ঠ বৃত্তও। ১৯৯৫ সালের ২০ নভেম্বর বিবিসি-তে সম্প্রচারিত ওই সাক্ষাৎকার মোটেও ভালভাবে নেয়নি বাকিংহাম প্রাসাদ। ঠিক ১ মাস পরে প্রাসাদসূত্রে জানানো হয়, চার্লস এবং ডায়ানাকে বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

১৯৯৬ সালের ২৮ আগস্ট বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয় চার্লস-ডায়ানার। বিচ্ছেদের কারণ এবং শর্ত প্রকাশ না করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হন দু’জনই। ডায়ানা নামের পাশ থেকে চলে যায় ‘হার রয়্যাল হাইনেস’ সম্বোধন। সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর মা হিসেবে তিনি রয়ে যান শুধুই ‘প্রিন্সেস অব ওয়েলস’ হয়ে।

রাজ সম্বোধন নিয়ে মোহ ছিল না ডায়ানার। শোনা যায়, রানির ইচ্ছে ছিল ডায়ানা বিচ্ছেদের পরও ‘তার রয়্যাল হাইনেস’ ব্যবহার করুক। কিন্তু যুবারজ চার্লস সেটা চাননি। প্রিন্স উইলিয়াম নাকি মাকে বলেছিলেন, তিনি যখন রাজা হবেন, হারিয়ে যাওয়া ‘রয়্যাল হাইনেস’ উপাধি তাকে ফিরিয়ে দেবেন।

কিন্তু সে সুযোগ আর দেননি ডায়ানা। বিচ্ছেদের ঠিক পরের বছর ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট প্যারিসের বিখ্যাত পঁ দেআলমা সুড়ঙ্গে গাড়ি দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। পাপারাৎজিদের হাত থেকে বাঁচতে ঝড়ের বেগে চলছিল গাড়ি। তখনই এই দুর্ঘটনা। ডায়ানার সঙ্গেই মারা যান তার প্রেমিক মিশরীয় ধনকুবের ডোডি ফায়েদ এবং গাড়ির চালক অঁরি পল। তবে প্রাণে বেঁচে যান ডায়ানার দেহরক্ষী ট্রেভর রিজ জোনস।

মৃত্যুর পর ডায়ানার জীবন ঘিরে বিতর্ক যেন নতুন করে শুরু হল। যে সাক্ষাৎকার থেকে তার জীর্ণ দাম্পত্য প্রকাশ্যে আসে, এবার আঙুল উঠেছে তার দিকেই। অভিযোগ, সাংবাদিক বশির সাক্ষাৎকারের জন্য অসাধু উপায় নিয়েছিলেন। ডায়ানার ভাই চার্লস স্পেনসারের অভিযোগ, তাকে নকল নথি দেখানো হয়েছিল। যাতে তিনি বোনকে সাক্ষাৎকারের জন্য রাজি করান।

এমনকি, ডায়ানার ওপর নজরদারি চালানোর জন্য তার কর্মচারীদেরও বশির ঘুষ দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ। এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরে পদক্ষেপ নিয়েছে বিবিসি-ও। সংবাদ সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি জন ডাইসনের উপর।

তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিরুদ্ধে বশির অবশ্য এখনও কিছু বলেননি। বিবিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বশির এই মুহূর্তে খুবই দুর্বল। প্রসঙ্গত, বিবিসি-তে ডায়ানার ওই সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হওয়ার পরই অখ্যাত থেকে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন বশির।

তবে বিবিসি জানিয়েছে, তারা সত্য উদঘাটনের ব্যাপারে দৃঢ়। নিরপেক্ষ তদন্তে সত্য উঠে আসবে বলেই মনে করছে বিখ্যাত এই সংবাদ মাধ্যম।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password