নিজ দেশেই যখন বিদেশি

নিজ দেশেই যখন বিদেশি

আমরা বাংলাদেশের মানূষ অনেকাংশেই আমাদের রাজধানী ঢাকার উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের সিংহভাগই রাজধানীতে অবস্থিত। মূলত এই কারণেই প্রায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ কর্মসংস্থান বা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় রাজধানীতে আসছেন। এর ফলে ঢাকার উপর অনেক চাপ বাড়ছে। ক্রমস বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে আমাদের রাজধানী ঢাকা। কিন্ত আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো কখনও ভেবে দেখে না যারা গ্রাম থেকে এসে আমাদের শহরটাকে দূষিত করে তুলেছে তারা আমাদের শহরের মানুষের জীবন যাত্রার মান কতটা উন্নত করে তুলেছে। এই শ্রমজীবী মানুষগুলো ঢাকাতে আসার কারণেই স্থানীয়রা বাড়ি ভাড়া দিয়ে মোটা অংকের টাকা আয় করছেন। তাদের উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে দোকান-পাট, বাজার সহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ভাড়াটিয়াদের কারণেই সমিতির নামে দৈনিক কিস্তি ব্যাবসা রমরমা চলছে। বিভিন্ন জরিপেও দেখা যায় শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ভাড়াটিয়া। কোন কোন জরিপে এই সংখ্যাটা আরও বেশিও লক্ষ করা যায়।

বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখা বেসরকারি সংস্থা ভাড়াটিয়া পরিষদের তথ্য মতে, ঢাকা শহরে বসবাসকারী আড়াই কোটি মানুষের মধ্যে বাড়ির মালিক ১০ শতাংশ। বাকি ৯০ শতাংশই ভাড়াটিয়া। ৭০ শতাংশ ভাড়াটিয়া মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত। এছাড়া বাংলাদেশ শ্রমশক্তির জরিপ ২০১৭-১৮ থেকে জানা যায়, দেশের শতকরা প্রায় ২২ ভাগ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। এর মধ্যে গ্রাম এলাকায় মাত্র ৩ ভাগ ও শহরাঞ্চলে থাকেন শতকরা ৪৩ দশমিক ৬০ ভাগ। দেশের রাজধানী শহরে এই সংখ্যার সঠিক কোনো জরিপ পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় শতকরা ৭০-৮০ ভাগ লোক ভাড়া বাসায় থাকেন। ২০১৮-১৯ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশও এই বিষয়ে একটি জরিপ করেছে। জরিপে ডিএমপি ৬২ লাখ ৩৪ হাজার ৫৪৭ জনের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (সিআইএমএস) সংরক্ষণ করেছে। এর মধ্যে বাড়িওয়ালা দুই লাখ ৪১ হাজার ৫০৭ জন, ভাড়াটিয়া ১৮ লাখ ২০ হাজার ৯৪ জন, মেস সদস্য এক লাখ ২১ হাজার ৪০ জন, পরিবারের সদস্য ৩১ লাখ ৬৬ হাজার ৮২১ জন, ড্রাইভার ও গৃহকর্মী ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৯৮৪ জন।

স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে ঢাকা শহরের উন্নতিতে ভাড়াটিয়াদের কতটা অবদান। অথচ নানা দিকে ভাড়াটিয়ারা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে থাকে। ভাড়া নেয়া থেকে শুরু করে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় তাদের। প্রায়শই ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালা কর্তৃক নানা ধরনের অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হন। যেমন –যখন তখন ভাড়া বৃদ্ধি করা, বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করা, সময় মত বাসায় পানি না থাকাসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম। করোনাকালীণ বর্তমান সময়ে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের অনিয়ম ও হয়রানি প্রতিরোধে বাংলাদেশে প্রচলিত রয়েছে ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রন আইন। ভাড়াটের অধিকার এই আইনে লেখা আছে। এই অধিকার কোনো বাড়িওয়ালা লঙ্ঘন করলে তাঁকে পেতে হবে শাস্তি। এই আইন কতটা পালন হয় তা বলা মুশকিল। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ালেও লক্ষ্য করা যায় বাড়িওয়ালারা নির্দিষ্ট সময়ে  তাদের বাড়ির হোল্ডিং টেক্স দিতে মোটেও আগ্রহী নয়। এর জন্য রাস্তা ঘাটে অনেক সময় মাইকিং করতে শোনা যায় যারা যারা বাড়ির টেক্স পরিশোধ করে নাই তারা অবিলম্বে টেক্স পরিশোধ করে সরকারকে সহায়তা করুন।

এত গেল ভাড়াটিয়ার বাড়িওয়ালা বিড়ম্বনার বিষয়। এখন আসা যাক ভাড়াটিয়ার রাষ্ট্রীয় কিছু সমস্যার দিকে। যখন কোন সরকারি অনুদান আসে তখন প্রায় তারা এই সকল অনুদান থেকে বঞ্চিত হয়। অনুদানের জন্য গেলে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করা হয় আপনি কি এই এলাকার ভোটার? সেখানেই শেষ হয়ে যায় তার আশার আলো। অনেক কাজের ক্ষেত্রেই হঠাৎ করে জন্ম নিবন্ধন প্রয়োজন পড়ে তখন তারা মহা ঝামেলায় পড়ে থাকে। কারণ তারা যেখানে বসবাস করছে তারা ওই এলাকার ভোটার নয়। এক এলাকার জন্ম নিবন্ধন দিয়ে আরেক এলাকার ভোটার হওয়া গেলেও জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সেটা পাওয়া যায় না। ভোটার আইডি কার্ড থাকলেও জন্ম নিবন্ধন জোগাড় করতে গেলে প্রয়োজন হয় বাড়ির হোল্ডিং টেক্সের রশিদ। তখন আবার বাড়িরওলার কাছে অনুরোধ করতে হয় রশিদ বের করে দিতে। অনেকেই দিতে অনাগ্রহী হয় কারণ সময়তো ভাড়া আদায় করলেও তারা সময়মত তাদের টেক্স পরিশোধ করেন নাই।

সামাজিকভাবেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। সমাজে বাস করতে গেলে অনেক সময় বিভিন্ন মানুষের সাথে মতবিরোধ দেখা দেয়। এই কারণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তখন সালিশে এলাকার বড় ভাই বা মুরুব্বিরা প্রথমেই এসে জিজ্ঞেস করে এই তোমার বাড়ি কই? মানে তুমি এই এলাকার স্থানীয় না হয়েও স্থানীয়দের সাথে ঝামেলায় জড়ানোর সাহস কি করে পেলে। অনেকেই এই ব্যাপারে বিভিন্ন উক্তিও দিয়ে থাকে(যেমন, শালার বাইন দেশীরা আইসা আমাগো এলাকাটা নষ্ট করে দিল)। এ যেন নিজ দেশেই ভিনদেশী। আমরা যেন দিন দিন ভুলেই যাচ্ছি ভিন্ন এলাকার হলেও দিনশেষে আমরা সবাই কিন্তু বাংলাদেশী। নিজ দেশেই বিদেশিদের মতো জীবন যাপন করা কি বৈষম্য নয়?

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password