করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় চমেক হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু আছে। তবে রোগী বেশি থাকায় একটি পয়েন্টের অক্সিজেন চার-পাঁচজনকে ভাগাভাগি করে সরবরাহ করতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ ও আইসোলেশন ওয়ার্ডে ২০০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রস্তুত থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ৭৮টি। এছাড়া ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে ৩১টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে চলছে চিকিৎসা, যেখানে অন্তত ১০০টি সিলিন্ডার প্রয়োজন। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালেও অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে মাত্র ২০টি। রেলওয়ে হাসপাতাল ও হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালেও রয়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে সরকারিভাবে একটি ও বেসরকারি পর্যায়ে ৩টি কারখানায় অক্সিজেন উৎপাদন হয়। হাসপাতালে ব্যবহৃত অক্সিজেন সিলিন্ডারে অক্সিজেনের পরিমাণ থাকে ৯৯.৯৯ শতাংশ। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের সিলিন্ডারে অক্সিজেনের পরিমাণ থাকে ৬৫ শতাংশ। ২০১৮ সালে ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের বৃহৎ অক্সিজেন কারখানা চালু করে লিন্ডে বাংলাদেশে লিমিটেড। এতে দৈনিক ১০০ টন তরলকৃত গ্যাস উৎপাদন হয়।
এছাড়া বেসরকারি স্পেকট্রা গ্যাসেস লিমিটেড, ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড সহ ইসলাম গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, চট্টগ্রামের আবুল খায়ের গ্রুপ, জিপিএইচ, বিএসআরএম, গোল্ডেন অক্সিজেনসহ বড় বড় কারখানাগুলো অক্সিজেন উৎপাদন করে। নির্দিষ্ট ডিলারের মাধ্যমে এসব কারখানা থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।
সীতাকুণ্ডের (চট্টগ্রাম-৪) সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন অক্সিজেন লিমিটেড এর পক্ষ থেকে করোনা আক্রান্ত রোগীদের বিনামূল্যে অক্সিজেন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অক্সিজেন নেওয়ার জন্য সিলিন্ডার নিয়ে আসতে হবে।
সংসদ সদস্য দিদারুল আলম বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীরা অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এসব রোগীর জন্য আমাদের কারখানা থেকে বিনামূল্যে অক্সিজেন রিফিল করে দেবো। তবে সেক্ষেত্রে খালি সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, বর্তমানে আমাদের প্রতিষ্ঠানে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট আছে। আমরা চাই, চট্টগ্রামের কোনও রোগীই যেন অক্সিজেনের অভাবে মারা না যান।
শিল্প প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের গ্রুপের উদ্যোগে করোনা রোগীর চিকিৎসার্থে নিজস্ব প্ল্যান্ট থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করার লক্ষ্যে ৩শ’সিলিন্ডার আমদানি করা হয়। গত ১২ মে থেকে বিনামূল্যে অক্সিজেন সরবরাহ কার্যক্রম শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান। তবে রোগীর তুলনায় তাও অপ্রতুল।
আবুল খায়ের গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার (মানবসম্পদ বিভাগ) ইমরুল কাদের ভূঁইয়া বলেন, আবুল খায়ের গ্রুপ নিজস্ব প্ল্যান্ট থেকে প্রতিদিন ২৬০ মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদন করে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সিলিন্ডারের প্রতিটিতে এক দশমিক চার কিউবিক মিটার অক্সিজেন ধারণক্ষমতা রয়েছে। গত ২ মে আবুল খায়ের গ্রুপের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। তারই আলোকে বিশেষায়িত সকল করোনা হাসপাতালে বিনামূল্যে সিলিন্ডারসহ অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। একটি সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হলে পুনরায় রিফিল করে দেওয়া হচ্ছে। এজন্য একটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া দেশে করোনা চিকিৎসায় যেসব হাসপাতাল নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেসব হাসপাতালের নিজস্ব যে বিশেষায়িত অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে, তারাও নিজেরা এসে ফ্রি অক্সিজেন রিফিল বা ভর্তি করে নিতে পারবেন।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য ছোট আকৃতির যেসব অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে, সেগুলোর অক্সিজেন ধারণক্ষমতা এক দশমিক ৩৬ কিউবিক লিটার। মুমূর্ষু রোগীর জন্য ঘণ্টায় ৫ লিটার গতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করা হলে দুই ঘণ্টার মধ্যেই এসব সিলিন্ডার খালি হয়ে যায়। এছাড়া আইসিইউতে বড় আকৃতির যেসব সিলিন্ডার আছে, সেগুলোর অক্সিজেন ধারণক্ষমতা আট দশমিক ৬ কিউবিক লিটার।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নবনির্মিত ১৪ তলা ভবনে ১০টি ভেন্টিলেটর সুবিধাসহ করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবায় চালু হয়েছে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা। সেখানেও রোগীর চাপ বাড়লে একটি পয়েন্টের অক্সিজেন কয়েকজনকে ভাগাভাগি করে দেওয়া হতে পারে বলে আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বাজারে এরইমধ্যে অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি থাকায় বাড়তি দামেও মিলছে না জীবনরক্ষাকারী অক্সিজেন সিলিন্ডার। প্রচুর চাহিদার কারণে হোম সার্ভিস হিসেবে অক্সিজেন সিলিন্ডার ডেলিভারির বেশকিছু প্রতিষ্ঠানও এরই মধ্যে গজিয়ে উঠেছে। আগের চেয়ে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে একেকটি সিলিন্ডার। স্বল্প সময়ের জন্য ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে সিলিন্ডার। সিলিন্ডারের পাশাপাশি পোর্টেবল অক্সিজেন ক্যান, পোর্টেবল ভেন্টিলেটর এবং অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ফ্লো মিটারও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। সাড়ে ৩ লিটার অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম এখন ২০ হাজার টাকা। যা আগে ছিল ৫-৭ হাজার টাকা। ২৫০ টাকার অক্সিজেন মাস্কের দাম বেড়ে ৫শ এবং অক্সিজেন গ্রহণের কাজে ব্যবহৃত ৮০ টাকার ক্যানোলার দাম নেওয়া হচ্ছে ৩শ টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, একেকটি প্রতিষ্ঠানে আগে যেখানে প্রতিমাসে হাতে দুই থেকে তিনটি সিলিন্ডার বিক্রি হতো, এখন সেখানে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০টি সিলিন্ডার। আর এসব সিলিন্ডারের বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। আমদানির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাজারে সিলিন্ডারের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে সময়ের প্রয়োজন রয়েছে।
পাঁচলাইশের বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ শহীদুল আলম বিডিটাইপকে জানান, আগে বেশিরভাগ গ্রাহক সিলিন্ডার ভাড়ায় নিয়ে যেতেন। হাসপাতাল থেকে পরে সেই সিলিন্ডার ফেরত নিয়ে আসা হতো। এখন অনেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার বাসায় কিনে নিয়ে গেছে। বর্তমানে আমাদের কাছে চাহিদামতো সিলিন্ডার না থাকায় দিতে পারছি না। যারা সিলিন্ডার আমদানি করেন, তারাই আমাদেরকে সিলিন্ডার সরবরাহ দিতে পারছেন না। এছাড়া গত এক সপ্তাহ ধরে অক্সিজেন রেগুলেটরও পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়াই অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারে প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা জানান, সাধারণ দুইভাবে অক্সিজেন দেওয়া হয়। একটি মাস্কের সাহায্যে, অন্যটি ভেন্টিলেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে। দুটি পদ্ধতিতেই চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। কারণ দেহের অক্সিজেন লেভেল পরিমাপের পরই প্রতি মিনিটে কতটুকু অক্সিজেন প্রবাহ প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করা হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মনোজ চৌধুরী বিডিটাইপকে বলেন, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বা স্যাচুরেশন ৯৩ শতাংশের নিচে নেমে গেলে প্রথমে অল্প মাত্রায় অক্সিজেন দিতে হয়। এতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অক্সিজেনের মাত্রা দ্বিগুণ করা হয়। অক্সিজেন বেশি মাত্রায় নিলে ক্ষতির ঝুঁকিও আছে। এজন্য অক্সিজেন নেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুসরণ করেই তা দেওয়া উচিত। এছাড়া বাসায় সিলিন্ডার মজুদ করা হলে বিস্ফোরণেরও ঝুঁকি থাকে। কারণ সিলিন্ডারে উচ্চ চাপে অক্সিজেন ভরে রাখা হয়।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ মার্চ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের সঙ্গে বৈঠকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের পরিবর্তে মেডিক্যাল অক্সিজেন উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বেসরকারি অক্সিজেন গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়- দেশের জরুরি প্রয়োজনে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন গ্যাসের পরিবর্তে মেডিক্যাল অক্সিজেন গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি করবে এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার, ফ্লো-মিটার আমদানি বৃদ্ধি করবে। অক্সিজেন গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে হাসপাতালগুলো তাদের আগামী তিন মাসের চাহিদা জানাবে। চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সিলিন্ডার, ফ্লো-মিটার আমদানি এবং মেডিক্যাল অক্সিজেন গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন