সুপার সাইক্লোন আম্ফানের প্রলয়ঙ্করী ছোবল ঠেকিয়ে দিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে সুন্দরবন। বিশ্বে জীববৈচিত্র্যের বৃহত্তম আধার এই ম্যানগ্রোভ বনটি অক্সিজেনের ভান্ডার। বাংলাদেশের ফুসফুস এই সংরক্ষিত বনে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পরে তার প্রাণ-প্রকৃতি কী অবস্থায় রয়েছে? এখন এই ক্ষত নিয়ে কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে সুন্দরবন? সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা গবেষক ও বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবনকে তার মতো করে থাকতে দিলে আগামী পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে এই বনটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। প্রাণ ফিরে পাবে সুন্দরবন।
জানা যায়, বুধবার সন্ধ্যায় মিনিটে সুপার সাইক্লোন আম্ফান প্রথমে পূর্ব সুন্দরবনের দুবলা ও কটকায় আঘাত হেনে রাতভর এই ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ বনে তা-ব চালায়। আম্ফান সুন্দরবনে আঘাত হানার আগে তিন থেকে পাঁচ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে বন তলিয়ে যেতে শুরু করলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দলে দলে কয়েকশ হরিণ সুন্দরবনের কটকা, দুবলা, চরাপুটিয়া ও কোকিলমুনি বন অফিসের কম্পাউন্ডে দল বেঁধে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নেওয়া এসব হরিণ সকালে আবার বনে ফিরে গেছে। সাইক্লোন আম্ফানে রাতভর চলে জড়ের তা-ব। প্রাথমিকভাবে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ৮টি বন অফিসের টিনের চালা উড়ে গেছে ও সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে ৫টি জেটি।
সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, সুন্দরবনকে তার মতো করে থাকতে দিলে আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে এই বনটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। গত দেড়শ বছরে ৭৫টি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ল-ভ- হয়ে যায় সুন্দরবন। তারপরও সুন্দরবন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, নিকট অতীতে সুন্দরবন সুপার সাইক্লোন সিডর, আইলা, বুলবুলের ক্ষত কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন বন বিভাগকে প্রাথমিক অবস্থায় দ্রুত দুটি কাজ করতে হবে। গাছগুলো ভেঙে যে অবস্থায় আছে সেভাবেই রেখে দিতে হবে। জলোচ্ছ্বাসে বন অভ্যন্তরে বন্যপ্রাণীর খাবারের উৎস মিঠাপানির পুকুরগুলোতে যে লবণ পানি ঢুকেছে তা দ্রুত পাম্প করে বের করে দিতে হবে। বৃষ্টির পানিতে দ্রুত পুকুরগুলোতে আবার পানি জমবে।
প্রতিবারই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে সুন্দরবন উপকূলের কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করে চলেছে। এখন সময় এসেছে সুন্দরবনকে রক্ষায় সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সুন্দরবনের সব বন অফিসের ভবন ও জেটি ঘূর্ণিঝড় সহনীয় করে নির্মাণ, আগুনের হাত থেকে বাংলাদেশের এই ফুসফুসকে রক্ষায় এই বনের জন্য নিজস্ব ভাসমান অগ্নিনির্বাপক নৌযান ক্রয়, বনের লোকালয় সন্নিহিত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, জেলে-বনজীবীদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, বন্যপ্রাণীর খাবারের মিঠাপানির জন্য পর্যাপ্ত পুকুর খননসহ সুন্দরবন সুরক্ষায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যেসব প্রকল্প আটকে রয়েছে, সেসব প্রকল্পে দ্রুত অনুমোদন দিয়ে অর্থ ছাড় করার দাবি জানান এই পরিবেশবিদ।
বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। সুন্দরবনকে তার মতো করে থাকতে দিলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই বনটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। এখন বন বিভাগ ঝড়ে বিধ্বস্ত গাছপালা সুন্দরবনে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায়ই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মিঠাপানির পুকুরগুলোতে জলোচ্ছ্বাসে ভরে যাওয়া লবণ পানি দ্রুত পাম্প করে অপসারণের কাজ শুরু হবে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য অবকাঠামোসহ ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত অবস্থা জানতে চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। চারটি রেঞ্জের এসিএফদের প্রধান করে সাত সদস্যবিশিষ্ট এসব
কমিটি তিন কর্মদিবসের মধ্যে সরেজমিনে সুন্দরবনের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করে রিপোর্ট দেবে। তখন সুন্দরবনের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানা যাবে। প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি, রাতভর ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সুন্দরবনে তা-ব চালালেও শরণখোলা, চাঁদপাই ও খুলনা রেঞ্জের চেয়ে সাতক্ষীরা রেঞ্জে ক্ষতির পরিমাণ বেশি।
বাগেরহাটের পূর্ব ও খুলনার পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের চারটি রেঞ্জের বিভিন্ন ফরেস্ট অফিস, টহল ফাঁড়ির কর্মকর্তারা জানান, সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইডের পাশাপাশি বিশ্বের বৃহৎ জলাভূমিও। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। এ ছাড়া সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমাণ ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। এই জল ভাগে ছোট-বড় ৪৫০টি নদী ও খালে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও এক প্রজাতির লবস্টার।
সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৬৮ দশমিক ৮৫ ভাগ অর্থাৎ ৪ হাজার ২৪২ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার হচ্ছে স্থল ভাগ। সংরক্ষিত এই বনের তিনটি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ঘোষণা করে। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩০ ভাগ এলাকা। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি রয়েছে। এ ছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে।
ইতিধ্যেই সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে এক প্রজাতির বন্য মহিষ, দুই প্রজাতির হরিণ, দুই প্রজাতির গন্ডার, এক প্রজাতির মিঠাপানির কুমির। গোটা সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জর ১৮টি রাজস্ব অফিস, ৫৬টি টহল ফাঁড়িতে সর্বমোট জনবলের সংখ্যা ৮৮৯ জন। এই অপ্রতুল জনবল দিয়ে বিশাল এই সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতিকে দেখভাল করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। দেশে করোনাকালে সুন্দরবনে রেডঅ্যালার্ড জারির পর বুধবার সন্ধ্যায় সুপার সাইক্লোন আম্ফান আঘাত হানার আগ পর্যন্ত ভালোই ছিল এই বনটি।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন