প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকার ইসলামের নামে অগ্নিসংযোগ হামলা ও ভাঙচুরের মতো অনৈসলামিক কার্যক্রমকে সহ্য করবে না। অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।রোববার অপরাহ্নে একাদশ জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু লোকের জন্য ইসলাম ধর্মের বদনাম হবে, এটা কখনোই মেনে নেয়া যায় না। এই ধরনের অপকর্মে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। যারা মুখে ধর্মের কথা বলে, আর অধর্মীয় কাজ করবেন, এটা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।তিনি বলেন, ২৬ মার্চ অনেক মানুষের জীবন গেছে। এর জন্য দায়ী তো তারা। কাজেই আমি শুধু এইটুক বলব দেশবাসী যেন একটু ধৈর্য ধরেন। আমাদের সবাইকে ধৈর্য ধরেই এগোতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা দুঃখজনক বিষয় হলো, যখন আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি, সেই সময়ে ঘটনাগুলো ঘটানো হলো। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যেখানে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি, সেই সময় আমাদের অনেক বিদেশি অতিথি আসছে। অনেকে বার্তা দিচ্ছেন। ব্রিটেনের রানি থেকে শুরু করে সৌদি বাদশা সবার বার্তা আমরা পাচ্ছি। এতো বড় একটা সম্মান বাংলাদেশ পাচ্ছে। সেখানে কারা খুশি হতে পারেনি?
তিনি বলেন, ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসার কথা। তাকে আসতে দেয়া যাবে না, এজন্য হেফাজতে ইসলাম কর্মসূচি দেয়। তারা কী শিক্ষা গ্রহণ করতে দেওবন্দে যায় না? তারা যদি এসব ঘটনা ঘটায়, তবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে দেওবন্দে যাবে কীভাবে, সেটা কী তারা একবারও চিন্তা করেছে?প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা তো কওমি মাদরাসায় সনদ দিচ্ছি। তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি, তাদের কারিকুলাম ঠিক করে দিচ্ছি। তারা যেন দেশে-বিদেশে চাকরির পায়, তার ব্যবস্থাও করে দিচ্ছি। তারপরেও কেন তারা এই তাণ্ডব ঘটালো?
বিএনপি তাদের সমর্থন দিচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট কীভাবে সমর্থন দিচ্ছে, সেটাই আমার প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী মোদি আসবে সেখানে তাদের আপত্তি।তিনি বলেন, বিএনপির কর্মকাণ্ড দেখে আমার খুব অবাক লাগে। হেফাজতের সঙ্গে যত রকমের মদদ দেয়া, জ্বালাও পোড়াও করার যে পরামর্শ, সেটাও তারা দিয়েছে। এদের রাজনৈতিক কোনো আদর্শ নেই। কোনো আদর্শ নিয়ে তারা চলে না।
হেফাজত কাণ্ড নিয়ে সবিস্তারে সংসদে সচিত্র প্রতিবেদন উপস্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে কেউ কেউ বলছেন পুলিশ কেন ধৈর্য দেখিয়েছে? আমরা ধৈর্য দেখিয়েছি, এগুলো বিরত করার চেষ্টা করেছি। কারণ সংঘাতে সংঘাত বাড়ে, আমরা তা চাইনি। আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ভালোভাবে উদযাপন করতে চেয়েছি।তিনি বলেন, যারা এটা করছে, দেশবাসী এটার বিচার করবে। দেশবাসী দেখবে এবং এদের চরিত্রটা কী? গতকাল দেখেছেন এরা একদিকে ইসলামের নামে, ধর্মের নামে, পবিত্রতার নামে এতো কিছু বলে আবার গিয়ে একটা অপবিত্র কাজ করে আসে, ধরা পড়ে সোনারগাঁও’র রিসোর্টে।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব এবং হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুহম্মদ মামুনুল হকের অনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকার বিষয়ে বলেন, একটা রিসোর্টে ধরা পড়েছেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব। তিনি ধরা পড়লেন এবং সেটা ঢাকার জন্য নানা রকম চেষ্টা। পার্লারে কাজ করে এক মহিলা তাকে বৌ হিসেবে পরিচয় দেন, আবার নিজের বৌয়ের কাছে বলেন যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলে ফেলেছি।প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন- যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে এ রকম অসত্য কথা বলতে পারে? তারা তো বলতে পারে না। এরা কী ধর্ম পালন করে? মানুষকে কী ধর্ম শেখাবে?
শেখ হাসিনা বলেন, হেফাজতের যারা সদস্য তাদেরও অনুরোধ করব- একটু বুঝে নিন কেমন নেতৃত্ব আপনাদের। আগুন লাগিয়ে জ্বালাও পোড়াও করে বিনোদন করতে গেলেন একটা রিসোর্টে, তাও একজন সুন্দরী মহিলা নিয়ে। এটাই তো বাস্তবতা। অর্থাৎ এরা ইসলাম ধর্মের নামে কলঙ্ক। ইসলাম ধর্মকে তারা ছোট করে দিচ্ছেন।প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, কিছু লোকের জন্য এই ধর্মে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের নাম জুড়ে যাচ্ছে। আর এখন তো যে চরিত্র দেখালো দুশ্চরিত্রের নামও যোগ হয়ে যাচ্ছে।
সংসদ নেতা বলেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম। যে ইসলাম ধর্ম সব থেকে সহনশীলতার কথা শিখিয়েছে, শান্তির কথা বলেছে, সাধারণ মানুষের কথা বলেছে, মানুষের উন্নয়নের কথা বলেছে, সেই পবিত্র ধর্মকে এরা কলুষিত করে দিচ্ছে। এরা ধর্মের নামে ব্যবসা শুরু করেছে।তিনি বলেন, একজন মুসলমানের আরেকজন মুসলমানের জান মাল হেফাজত করা, রক্ষা করা দায়িত্ব। আর হেফাজতের নামে তারা জ্বালাও পোড়াও করে যাচ্ছে। আর বিএনপি জামায়াত হচ্ছে তাদের মদদদাতা। এই লজ্জা শুধু বাংলাদেশের জনগণের না, এই লজ্জা বিশ্বব্যাপী, পৃথিবীজুড়ে মুসলমানদের জন্য। পবিত্র ধর্মটাকে সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে দিচ্ছে। তাদের এসব কর্মকাণ্ডের ফলে বহু মানুষের জীবন গেছে।
করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভ এবং এক সপ্তাহের লকডাউন প্রসঙ্গেও বিস্তারিত সংসদে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনাভাইরাস নামের যে মহামারি দেখা দিয়েছিল, তার দ্বিতীয় ঢেউ এখন আবার শুরু হয়েছে। করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। জানি, কষ্ট হবে, তারপরেও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।তিনি সংসদে আসার আগেই দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে, নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশনা দিয়ে এসেছেন উল্লেখ করে বলেন, হয়তো মানুষের একটু সমস্যা হবে তারপরেও আমি বলবো জীবনটা অনেক বড়, জীবনটা আগে। মানুষের জীবন বাঁচানো, এটাই সবার আগে করণীয়।
তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্য করলাম ২৯, ৩০ ও ৩১ মার্চ এই তিনদিন খুব বেশি বেড়ে গেল করোনা মৃত্যু হার ও সংক্রমণ। এরপর থেকে এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মাস্ক পড়তে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে, বিয়ে-শাদি এসব অনুষ্ঠান সব বন্ধ রাখতে হবে। যেখানেই লোক বেশি, ভিড় হয় সেসব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে।লোক সমাগমে বা বাজারে গেলে সেখান থেকে ফিরেই গরম পানির ভাপ গ্রহণে সবাইকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এবারের ভাইরাসের ধরণটা এমন চট করে বোঝা যায় না কি হয়েছে, হঠাৎ করেই খারাপ অবস্থা হয়ে যায়। যে কারণে সবাইকে সাবধান থাকার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ জানাচ্ছি।
এর আগে দেখা গেছে করোনায় বয়স্করাই সংক্রমিত হয়। কিন্তু নতুন রোগের ধরণে দেখা যাচ্ছে; তরুণ ও শিশুরাও সংক্রমিত হচ্ছে। কাজেই তরুণ ও শিশুদেরও সুরক্ষিত রাখতে হবে। সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্যও সবাইকে আবেদন জানান প্রধানমন্ত্রী।তিনি বলেন, তাছাড়া আমরা পর্যটনও বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিভিন্ন দেশের যাত্রীদের প্রবেশস্থলেও কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং কয়েকটি দেশ এরই মধ্যেই তাদের যাতায়াত বন্ধ করেছে। শপিংমলগুলোতে অনলাইনে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে, কিন্তু সরাসরি পণ্য সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে। ১১ এপ্রিলের (ইউপি) নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে যেন মানুষের সংক্রমণ না হয়।
সরকার সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে উল্লেখ কলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা দিয়েছি। এতে করে আমরা মনে করি যে ব্যবস্থা নিয়েছি সেটাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আসবে। সরকার ভ্যাকসিন দেয়া শুরু করেছে। তবে এরপরে মানুষ যেন একটু ডেসপারেট হয়ে গেছে এটা বন্ধ করতে হবে। সবাইকে অবাধে চলাফেরাটা বন্ধ করতে হবে।এ সময় মুজিববর্ষ উপলক্ষে চলমান বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তার সরকারের গৃহহীনদের ঘর করে দেয়ার অঙ্গীকারের কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন