সাগরগর্ভে কক্সবাজারের ‘ধলঘাটা’গৃহহারা সাড়ে ছয় হাজার

সাগরগর্ভে কক্সবাজারের ‘ধলঘাটা’গৃহহারা সাড়ে ছয় হাজার
MostPlay

কক্সবাজার: কক্সবাজারের মহেশখালীর সাগরবেষ্টিত ইউনিয়ন ‘ধলঘাটা’ সাগরের করাল গ্রাসে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। গত ৩১ বছরে সাড়ে তিন হাজার একর জমি সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সমুদ্রের ভাঙনের কবলে পড়ে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার গ্রামবাসী গৃহহারা হয়ে পড়েছে।

তবে এলাকাটি রক্ষায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ উন্নয়নের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এই কাজ ২০২৫ সাল নাগাদ শেষ হবে বলে জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। স্থানীয় মাস্টার মনজুর আহমদ জানান, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে ধলঘাটা ইউনিয়ন অরক্ষিত হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মাটির সঙ্গে মিছে গিয়েছিল। এরপর থেকে শত চেষ্টা সত্ত্বেও ধলঘাটায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তারপর ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে আরেক দফা ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে ধলঘাটা। দুই দফা সাইক্লোনের পর রীতিমতো জোয়ার-ভাটায় সয়লাব হতে থাকে ইউনিয়নটি।

সমুদ্রের ভাঙনের কবলে পড়া এসব লোকজন আশ্রয় নেন উঁচু এলাকায়। বিশেষ করে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চকরিয়া, লামা, আলীকদম, বান্দরবান, মহেশখালী দ্বীপের উঁচু এলাকা হোয়ানক, শাপলাপুর ও কালারমারছড়াসহ বিভিন্ন এলাকায়। এক সময়ের ধলঘাটা খাতুর বাপের পাড়ার বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, ধলঘাটা ছেড়ে চলে এসেছি ৩২ বছর আগে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে আমার বাড়িঘর সাগরে বিলীন হয়ে যায়।

সেই সাথে সাগর কেড়ে নিয়েছিল আমার তিন সন্তান। তখন নিঃস্ব হয়ে আমার পরিবার নিয়ে চলে আসি মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নে। এখানে এসে নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করেছি। কিন্তু এখনো সেই কালো রাত্রির কথা ভুলিনি। বারবার মনে পড়ে আমার তিন সন্তানের কথা। স্থানীয় বাসিন্দা এজাহার মিয়া বলেন, ১৯৫০ সালে আমি ধলঘাটার সুতরিয়ায় জন্মগ্রহণ করি। এই গ্রামে আমার জীবন-যৌবন কেটেছে।

এ জমিতে আমার মা-বাবার করব রয়েছে। যৌবনে কৃষি কাজ করে সংসার চালিয়েছিলাম বেশ। এখন আমি বয়সের বাড়ে নুয়ে পড়েছি। ছেলে সন্তানদেরও তেমন পড়াশোনা করাতে পারিনি। তাই তারাও আমার পেশায় যুক্ত রয়েছে। কৃষিই আমাদের জীবনের চালিকাশক্তি। কৃষি কাজ করে সংসার চলে। আমি এই জীবনে কোনোদিন শহর দেখিনি এবং দেখার ইচ্ছেও নেই। গ্রামই আমার সব।

শুনছি উন্নয়নের জন্য নাকি আমাদের ধলঘাটা ছেড়ে দিতে হবে। চলে যেতে হবে শহরে। আমি এই গ্রাম ছেড়ে যেতে চাই না। আমার বাবা-মার কবরের পাশে থাকতে চাই। ধলঘাটা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুল হাসান জানিয়েছেন, ৩ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমানে ১০০/১৫০ জন ভোটার রয়েছেন, যেখানে গত ১০ বছর আগেও দুই থেকে আড়াই হাজার ভোটার ছিল।

এই ওয়ার্ডগুলোকে ভোটার সমবণ্টনের মাধ্যমে পুনঃবিন্যাস করে সীমানা নির্ধারণে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে ইসি কার্যালয়ে আবেদন করা হয়েছে। আদমশুমারির তথ্যানুযায়ী, ১৯৯১ সালে ধলঘাটার জনসংখ্যা ছিল ৩১ হাজার। বর্তমানে এই ইউনিয়নের জনসংখ্যা ১৩ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। ৯১/৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ১০ হাজার লোক মারা যায়।

পুরো ইউনিয়েনের আয়তন ৯১ সালের আগে ছিল ২০ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে এই দ্বীপের আয়তন ৮/১০ বর্গকিলোমিটারে চলে এসেছে। অব্যাহত সাগরের ভাঙনের ফলে ধলঘাটা ইউনিয়ন মারাত্মক হুমকির মুখে। যে কারণে হাজার হাজার লোক উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকার ধলঘাটাকে রক্ষা করতে উন্নয়নের মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দেশি-বিদেশি হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে ১২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার।

জমি মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৫১০ একর জমির ওপর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে ভেজা টিকে গ্রুপ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর অবশিষ্ট জমিতে কী প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্প করা হচ্ছে তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী জানিয়েছেন, ধলঘাটা ইউনিয়নকে সাগরের ভাঙন থেকে বাঁচাতে মহাপরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। একাধিক বার সার্ভে করে সাগরে বিলীন হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধার করে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করার ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাস হলে একনেকের অনুমোদনসাপেক্ষে টেন্ডারের পর কাজ শুরু করা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন পাউবোর এই কর্মকর্তা।

মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন কাজ শেষ হলে ধলঘাটা হবে শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চল ও পর্যটকদের কাছে মনোমুগ্ধকর আকর্ষণীয় স্থান। সেই সাথে এলাকার বেকার যুবক-যুবতিদের কর্মসংস্থানের ঊর্বর ক্ষেত্র হবে এই অঞ্চল। আর গৃহহারা উদ্বাস্তুরা ফিরে পারে তাদের স্বপ্নের ঠিকানা। ধলঘাটার ভাঙন প্রতিরোধ ও টেকসই উন্নয়নে ইতিমধ্যে সরকার ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

সেখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল মাতারবাড়ির বন্দর সম্প্রসারণ হয়ে ধলঘাটা পর্যন্ত চলে আসবে। সেখানে বিশেষ এলএনজি টার্মিনাল ও মিনি এয়ারপোর্টসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করার সরকারের সিদ্ধান্ত রয়েছে। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হওয়ার পর খুব শিগগির কাজ শুরু হবে।

আশেক উল্লাহ রফিক, সংসদ সদস্য, কক্সবাজার-২ জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন, ধলঘাটা ইউনিয়নকে উন্নয়নের মেগা প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করে জমি অধিগ্রহণসহ নানা কর্মযজ্ঞ চলছে। বিলীন হয়ে যাওয়া ধলঘাটার ভূমি উদ্ধারে বিশেষ প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি এবং নকশা প্রণয়নের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password