বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের প্রভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিশ্বের অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি হারাচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। এরই পথ ধরে করোনা ভাইরাসের থাবা পড়েছে দেশের রপ্তানির ৮৪ ভাগ আয় আসা পোশাকখাতেও।তৈরি পোশাক কারখানায় লেঅফ ও শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়। দেখা দেয় শ্রম অসন্তোষ। পোশাকখাতের সমস্যা নিরসনে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় মে মাস পর্যন্ত শ্রমিক ছাঁটাই ও লেঅফ না করার অঙ্গীকার করে মালিকপক্ষ। তবে ঈদুল ফিতরের পর থেকে আবার একের পর এক শুরু হয় শ্রমিক ছাঁটাই।
পোশাকশিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, কারখানায় কাজ না থাকা সত্ত্বেও দুই মাস ধরে বেতন দেওয়া হয়েছে শ্রমিকদের। উন্নত বিশ্বে বড় বড় কোম্পানির কাজ বন্ধ থাকায় শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর কারখানা লেঅফ করে আমরা ৬০ শতাংশ বেতন দিয়েছি। কারখানায় কাজ না থাকলে বসে বসে বেতন কীভাবে দেব আর।
মালিকপক্ষের আশঙ্কা বর্তমান পরিস্থিতিতে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এক বছরের মধ্যে কারখানায় ২৫ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই হতে পারে। বর্তমানে ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান পোশাকখাত। সে হিসেবে কাজ হারাতে পারেন ১০ লাখ শ্রমিক।
তবে উদ্যোক্তাদের কথার সঙ্গে একমত নন শ্রমিক নেতারা। তাদের মতে, কোনো কারখানা মালিক বসিয়ে রেখে শ্রমিকের বেতন দেননি। তারা কাজ করেছেন। জীবন বাজি রেখে কারখানায় এসেছেন। আর শ্রমিক ছাঁটাই করতে হলে শ্রম আইন অনুযায়ী করতে হবে। তাদের সুযোগ-সুবিধা বুঝিয়ে দিতে হবে। বর্তমানে মালিকপক্ষ সেটা না করে মুনাফার জন্য যা যা করার তাই করছে। এটা হতে দেওয়া হবে না।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। প্রণোদনার অর্থ থেকে এখন শ্রমিকদের বেতন হচ্ছে। এছাড়া ঋণ, এলসি সেটলমেন্ট, পরিষেবার বিল পরিশোধ, ভ্যাট ট্যাক্সসহ বেশ কিছু খাতে সুবিধা দেওয়া হয়েছে পোশাকশিল্প উদ্যোক্তাদের। পোশাকখাতে শ্রমিকরা যাতে চাকরি না হারান, সে জন্য বিশাল অঙ্কের প্রণোদনার পাশাপাশি দাতা প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতারা পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন।
কিন্তু এরপরও একের পর এক ছাঁটাইয়ের শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা। শিল্প উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী এক বছরের মধ্যে আরও শতাধিক কারখানা বন্ধ হতে পারে। ইতোমধ্যে ২৫/২৬টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। অনেকে বন্ধের নোটিশ দিয়েছে। আর বিকেএমইএ বা বিজিএমইএ-এর সদস্য না এমন আরও বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
গত ২৫ এপ্রিল ত্রিপক্ষীয় (সরকার, মালিক, শ্রমিক) পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) এক নম্বর সিদ্ধান্ত অনুসারে করোনা সংকটের এই সময়ে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ এবং কারখানা লেঅফ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধের নির্দেশ দিয়ে রেববার (০৭ জুন) মালিকপক্ষকে চিঠি দিয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিডিটাইপকে বলেন, বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত দেশের বহু নামিদামি কোম্পানির কাজ না থাকায় শ্রমিক ছাঁটাই করছে। এ পরিস্থিতিতে পোশাকখাতে ক্যাপাসিটি লস, ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ায় বহু কারখানা বন্ধ হয়েছে। আরও বন্ধ হবে। এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এক বছরের মধ্যে ২৫ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই হতে পারে। যা প্রায় ১০ লাখ।
তিনি বলেন, ছাঁটাইয়ের কারণ কারখানায় কাজ না থাকা। কাজ না থাকলে মালিকদের পক্ষে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা চালিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। আমরা কোনো ছাঁটাই চাই না, শ্রমিক নিয়েই আমাদের কাজ। তবে কাজ না থাকলে কী করার। ইতোমধ্যে কাজ না করেও বসে থেকে দুই মাসের বেতন পেয়েছেন।
তবে কারখানা মালিকরা মুনাফার জন্য সবকিছু করছেন। তারা শ্রমিকের কথা না ভেবে মুনাফাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।এ বিষয়ে শ্রমিকনেতা আবুল হোসাইন বিডিটাইপকে বলেন, সরকারের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক সভার সিদ্ধান্ত মতে করোনাকালে শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না। কিন্তু মালিকপক্ষ তখন হাজার হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। এখন আবার ছাঁটাইয়ের কথা বলছেন।
তিনি বলেন, কোনো রকম আইনের তোয়াক্কা না করে মুনাফার আশায় শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে। ছাঁটাই করতে হলে তার পাওনা, সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়, যেটা করা হচ্ছে না।তিনি আরও বলেন, অন্যায়ভাবে শ্রমিক ছাঁটাই মানা হবে না। হতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে অস্থিরতা দেখা দিলে মালিকপক্ষকে এর দায়ভার নিতে হবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন