মশা নিধনে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না

মশা নিধনে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না
MostPlay

মশা নিধনে ৪ বছরে ডিএসসিসির ব্যয় ৭৬ কোটি

ডিএনসিসির নোভালুরন ব্যবহৃত এলাকায়ই বেশি মশা

ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচন এলেই নাগরিক সেবার নানান প্রতিশ্রুতি দেন প্রার্থীরা। সেই তালিকায় সবার ওপরে থাকে মশা নিধন। প্রার্থীদের দেয়া সেই প্রতিশ্রুতিতে আশায় বুক বাঁধেন নগরবাসী। তবে হতাশার কথা হলো, এখন পর্যন্ত ঢাকার কোনো মেয়রই মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণে সফলতা অর্জন করতে পারেননি। উল্টো দিন যতোই যাচ্ছে, রাজধানীতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মশা। বাড়ছে মশাবাহিত রোগ, এমনকি সেই রোগে ঝরছে প্রাণও।

 আমাদের বিশেষজ্ঞ যারা আছেন, তারা ঘটনা ঘটে গেলে অনেক বড় বড় পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু ঘটনা ঘটার আগে আমাদের কী করণীয়, আমাদের কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে রকম পরামর্শ আমরা পাই না 

রাজধানীতে মশার ঘনত্ব নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য বলছে, গত বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় মশার ঘনত্ব চারগুণ বেড়েছে। এখন যে মশা দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশই কিউলেক্স মশা। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে কিউলেক্স মশার প্রকোপ বাড়ে।

অথচ গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনের আগে মশা নিধনে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নির্বাচিত মেয়রেরা।

ডিএসসিসিতে শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হওয়ার আগে সংস্থার সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের মশা নিধন কার্যক্রমের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু এক বছরের মাথায় তাকেই সইতে হচ্ছে সেই সমালোচনা। সম্প্রতি নিজের মশা নিধন কৌশলেকিছুটা ভুল হয়েছে বলেও স্বীকার করেছেন তিনি।

একইভাবে সমালোচনার মুখে পড়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। মশা নিধনে তিনিও তার প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারেননি। তবে মশা নিধনে গত ৮ মার্চ থেকে সমন্বিত ক্র্যাশ প্রোগ্রাম কর্মসূচি শুরু করেছেন তিনি। আগামী ১৬ মার্চ পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে।

 এডিস এবং কিউলেক্স মশা নিধনে সিটি করপোরেশনকে বছরব্যাপী কর্মসূচি নিতে হবে। ওষুধের গুণগতমান এবং ব্যবহার যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে 

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার দুই মেয়রের শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘মশা আপনার ভোট যেন খেয়ে না ফেলে, সেটা নিশ্চয়ই আপনাদের দেখতে হবে। মশা ক্ষুদ্র হলেও অনেক শক্তিশালী। এটা মাথায় রাখতে হবে।

নগরবিদ ও কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, নির্বাচনের আগে মেয়রপ্রার্থীরা মশা নিধন, যানজট নিরসনসহ অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এর অধিকাংশই সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। আর যেসব প্রতিশ্রুতি সরাসরি সিটি করপোরেশনের বাস্তবায়ন করার কথা, সেগুলোতেও তারা অনেকাংশ সফল হতে পারেননি। তাই আগে নিজ সংস্থার কাজগুলো ঠিক মত করতে হবে।

মশা নিধনে যতো উদ্যোগ
১৯৯০ সালের আগে ঢাকা সিটি করপোরেশন ‘ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন’ নামে পরিচিত ছিল। পরে নাম পরিবর্তন হয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন করা হয়। ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি নগরবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগের দিন তিনি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জনসভা করেছিলেন। ওই জনসভায় তিনি নির্বাচনী ইশতেহার চারটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী পরিকল্পনা ছিল অন্যতম।

২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সাদেক হোসেন খোকা নির্বাচিত হন। তার নির্বাচনী ইশতেহারে ছয়টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। এর মধ্যে চার নম্বরে ছিল মশা নিধন। খোকা নির্বাচিত হওয়ার পর ঢাকায় অ্যারিয়াল স্প্রে করে মশা নিধন পরিকল্পনা করা হয়। সে সময় পরিবেশবাদীদের তীব্র বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মশা মারতে সম্প্রতি কর্তৃপক্ষকে ফগার মেশিন দেয় ডিএনসিসি

২০১৫ সালের এপ্রিলে নির্বাচনী ইশতেহারে ‘মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’ করে ডিএনসিসিতে আনিসুল হক ও ডিএসসিসিতে সাঈদ খোকন মেয়র নির্বাচিত হন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে আনিসুল হক মারা যাওয়ার পর নগরে ব্যাপকভাবে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকাসহ সারাদেশে এডিস মশার বিস্তার ঘটে।

পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় তা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশনকে হিমশিম খেতে হয়েছে। তখন দুই সিটি করপোরেশনের ওষুধের মান, কেনাকাটায় অনিয়ম, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব অবহেলাসহ অনেক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন নাগরিকেরা। এমনকি সাঈদ খোকন মেয়র পদে নির্বাচনে দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইলেও না পাওয়ার পেছনে এই মশা নিধনে ব্যর্থতাও দায়ী বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। সরকারি হিসাবে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ১১১ জন মারা যান।

মশা নিধনে ৪ বছরে ডিএসসিসির ব্যয় ৭৬ কোটি
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হিসাব বিভাগ সূত্র জানায়, (ডিএসসিসি) গত চার বছরে শুধু মশা মারতে ৭৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা খরচ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিবছরই মশা আগের তুলনায় বাড়ছে। এখন চলতি অর্থবছরে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এর মধ্যে গত জুন থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা।

মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে বিভিন্ন সময়ে কর্মসূচি পালন করে আসছে নানা সংগঠন

ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, মেয়র তাপস নির্বাচিত হওয়ার পরপরই মশা নিধনে গুরুত্ব দেন। এর মধ্যে মশার লার্ভা ধ্বংসে গত বছরের জুনে রমনা লেক, খিলগাঁও ঝিলসহ ঢাকা দক্ষিণের ১০টি অঞ্চলের পুকুর, জলাশয়ে হাঁস ও তেলাপিয়া মাছ ছাড়েন। কিন্তু এখন অধিকাংশ হাঁস মারা গেছে।কিছু হাঁস চুরি হয়েছে। ফলে যে উদ্দেশ্যে হাঁস অবমুক্ত করা হয়েছিল তার সুফল মেলেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার লেক, জলাশয়, পুকুরের পানি অনেক নোংরা। সেখানে প্রচুর জীবাণু রয়েছে। বাস্তবতা না বুঝে হাঁসগুলো ছাড়া হয়েছিল। এরমধ্যে বিদেশি প্রজাতির হাঁসের সংখ্যাই বেশি ছিল। অথচ এসব হাঁস দেখভাল এবং খাবারের ব্যবস্থা করেনি সংস্থাটি। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অধিকাংশ হাঁস মারা যায়। এখন নগরে কিউলেক্স মশার প্রভাব বাড়লেও ডিএসসিসি তেমন কোনো কর্মসূচি নেয়নি। আগের মতোই মশা নিধন কার্যক্রম ঢিলেঢালাভাবে চলছে।

যদিও কিউলেক্স মশার প্রকোপ উত্তরের তুলনায় দক্ষিণে কম বলে দাবি করেছেন সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। তিনি জানান, মশার ওষুধ ছিটানোর কাজের তদারকি বাড়াতে আরও বেশি তৎপর হচ্ছেন তারা।

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট এক হাজার ১৩৪ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন

তবে গত ৩ মার্চ পান্থপথে এক অনুষ্ঠানে ডিএসএসসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘আমাদের বিশেষজ্ঞ যারা আছেন, তারা ঘটনা ঘটে গেলে অনেক বড় বড় পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু ঘটনা ঘটার আগে আমাদের কী করণীয়, আমাদের কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে রকম পরামর্শ আমরা পাই না। আমাদেরকে বলা হয়েছিল—ডেঙ্গুর প্রকোপটা যেহেতু আছে, তাই এই কার্যক্রম ডিসেম্বর পর্যন্ত চালিয়ে নিতে হবে। কিন্তু সেই কার্যক্রমটা ভুল ছিল। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের কিউলেক্স মশার বিরুদ্ধে কার্যক্রম নেয়া উচিত ছিল। কারণ পানি বদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল।’

ডিএনসিসির নোভালুরন ব্যবহৃত এলাকায়ই বেশি মশা গত বছরের অক্টোবর থেকে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুরের ৬২৯টি লেক, খাল, জলাশয় চিহ্নিত করে ট্যাবলেট বড়ির মত দেখতে নোভালুরন ওষুধ ব্যবহার শুরু করে ডিএনসিসি। মশার প্রজনন ও বংশবিস্তার রোধে ওই ওষুধ ব্যবহার করেছিল বলে জানায় সংস্থাটি। কিন্তু এখন এই এলাকাগুলো শহরের অন্যতম মশাপ্রবণ এলাকা হিসেবে আলোচিত। অর্থাৎ ডিএনসিসির নোভালুরন পদ্ধতি কাজে লাগেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, কিউলেক্স মশা নিধনে গত ৮ মার্চ থেকে ডিএনসিসির ১০টি অঞ্চলে একযোগে ক্রাশ প্রোগ্রাম কর্মসূচি শুরু করেছেন তারা। এই কর্মসূচিতে এক হাজার ৪০০ কর্মী কাজ করছেন। এর মধ্যে ১০ মার্চ মেয়র আতিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে মোহাম্মদপুরের রিং রোডে সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে ক্রাশ প্রোগ্রাম কর্মসূচি শুরু করে ডিএনসিসি। তবে এই ক্রাশ প্রোগ্রামে মশার উপদ্রব কমছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা।

১০ মার্চ মেয়র আতিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে মোহাম্মদপুরের রিং রোডে সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে ক্রাশ প্রোগ্রাম কর্মসূচি শুরু করে ডিএনসিসি

গত ৯ মার্চ দারুসসালাম ঈদগাহ মাঠ এলাকায় ক্রাশ প্রোগ্রাম চালিয়েছিল ডিএনসিসি। স্থানীয় বাসিন্দা জয়নাল আবদীন বলেন, সিটি করপোরেশনের ক্রাশ প্রোগ্রামের পর ওই রাতেই মশার উপদ্রব ছিল। বাসায় কয়েল জ্বালানোর পাশাপাশি মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হয়েছে।

তবে ভিন্ন কথা বলেছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বিডিটাইপকে বলেন, ‘গত দুই দিন (৮ ও ৯ মার্চ) যেসব এলাকায় ক্রাশ প্রোগ্রাম চালানো হয়েছে, সেখানে মশার উপদ্রব কিছুটা কমেছে। তবে মশা নিধনে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ থেকে গেছে। আমরা দেখব এই ১০ দিনের অভিযান শেষে কী ফল দাঁড়ায়। থার্ড পার্টির কীটতত্ত্ববিদরা আমাকে জানাবে কী কী ভুল হয়েছে। এছাড়া এখন আমরা কীটনাশকের পরিমাণ (ডোজিং) নিয়ে চিন্তা করছি। অনেক ক্ষেত্রে মশা নকডাউন হচ্ছে না। ডোজিং বাড়ানো যায় কি-না সে বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদদের সঙ্গে কথা বলছি।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বিডিটাইপকে বলেন, ‘এডিস এবং কিউলেক্স মশা নিধনে সিটি করপোরেশনকে বছরব্যাপী কর্মসূচি নিতে হবে। ওষুধের গুণগতমান এবং ব্যবহার যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ওষুধের মান এবং ব্যবহার নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।;

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password