প্রবাসীরা নবাবজাদা নাকি আপনি চাকর?

প্রবাসীরা নবাবজাদা নাকি আপনি চাকর?

পিএম
আমাদের আদর্শ, পথ চলার সবচেয়ে বড় পাথেয়, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ভাষণের বিশেষ কয়টি পংক্তি দিয়েই লেখা শুরু করি।
‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনা দেয় ওই গরীব কৃষক; আপনার মাইনা দেয় ওই গরীব শ্রমিক; আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায় , আমরা বেচে থাকি ওদের টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলেন; ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন; ওরাই মালিক, ওদের টাকায়ই আপনার সংসার চলে!!!
আমাদের লেখাপড়া শিখাই সে কে ডা? আমার বাপ মা? আমরা মনে করি বাপ মা ; আমাদের লেখাপরা শেখায় সে কে?
আমার বাহে ডাক্তারি পাস করায় কে? আর ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করায় কে? আর সায়েন্সে পাস করায় কে? আর বৈজ্ঞানিক করে কে? আর অফিসার করে কে? কার টাকায়?
বাংলার দুঃখী জনগণের টাকায়!’
আজ থেকে বহুবছর আগে বঙ্গবন্ধু সত্য-সরল এই কথাগুলো বলে গিয়েছেন। তার কথাগুলো হুট করেই মাথায় চলে এলো। কারণ বঙ্গবন্ধু এমন একজন ব্যক্তি যিনি সবসময় সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলে গেছেন। তার দেখানো পথে চলেছে বলেই দেশ এখন উন্নয়নের রোলমডেল হয়েছে। এখন এই উন্নয়নের মাঝে যাদের অবদান অনেকটা, তারা হচ্ছেন আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা। বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিকভাবে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে, তার অন্যতম বড় খুটিটাই হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। এই প্রবাসীরা ভাগ্য ফেরাতেই সুদূর প্রবাসে পাড়ি জমায়, পশুর মতো সারাদিনে যে পরিশ্রম করে যা কামায় তা দেশে পাঠায়, আর সেটার ওপরেই আমাদের অর্থনীতি চলে।
অথচ এদের নিয়ে সরকারের বড় মন্ত্রী-আমলারা যখন বেফাঁস আপত্তিকর কথা বলে ফেলে, নড়েচড়ে বসতে হয় বৈকি। সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলে পত্রিকায় যখন দেখি প্রবাসীরা দেশে এলে নবাবজাদা হয়ে যান শিরোনামে সংবাদ, তাও আবার দেশের উচ্চপর্যায়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে, তখন চোখ কচলে পুরো খবরটি দেখতে ইচ্ছে হয় না আর। এই পররাষ্ট্র মন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রী-আমলাদের বিএমডব্লিউ গাড়ি, এই গাড়িটা কিন্তু হিসাব করে দেখলে ওই প্রবাসীদের রেমিটেন্সের টাকাতেই আসে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে তো হাড়ভাঙা খাটুনিতে টাকাগুলো কামান না। তিনি তো বসে বসে, মাঝেমাঝে কয়টা গালগল্প ছেড়ে রাষ্ট্র থেকে বেতনের টাকাগুলো নেন। তিনি যখন বলেন প্রবাসীরা দেশে এলে নবাবজাদা হয়ে যান, কথাটা খুব গায়ে লাগে আমাদের। কারণ হিসাব করলে তারা আসলেই দেশের প্রকৃত মালিক, এক অর্থে নবাবজাদা তাদেরই হওয়া উচিৎ।
উল্টো আমাদের মন্ত্রী, আমলা, উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন ব্যক্তিরা নিজের তৈরি এক সিংহাসনে বসে যে নবাবজাদার মতো আচরণ করেন, তারা আসলে এক অর্থে রাষ্ট্রের চাকর। আমাদের দুর্ভাগ্য যে রাষ্ট্রের মূলশক্তিরাই হয়ে গেছে চাকর, চাকররাই নবাবজাদার আসন গেড়ে বসেছেন। মূলশক্তিরা যদি কখনো মালিকের মতো আচরণ করেও বসেন তো চাকরদের আঁতে ঘা লাগে খুব, উল্টোপাল্টাও বলে বসেন।
এতো কথা বলার কারণ করোনাভাইরাস। বিশ্বে যখন করোনার ভয়াবহ অবস্থা, অনেক প্রবাসীই দেশে ফিরছেন। কোয়ারেন্টাইনে থাকা নিয়ে তাদের আপত্তির কথা আমরা সবাই শুনেছি। সেটার মীমাংসা তো করতেই পারেন আপনারা, কিন্তু এই অরূচিকর কথার বাহাস কেন?
কিছু সময়ের জন্য করোনাভাইরাসের বিষয়টি বাদ দিলাম। অন্য সময়ে প্রবাসীরা যখন দেশে আসে, তাদের যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাদের মালামাল নিয়ে সমস্যা, তাদের সঙ্গে কুরুচিকর ব্যবহার করা হয়, পদে পদে হেয় করা হয়। কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছি যে, এই লোকগুলো যদি ঘাম না ঝরাতো, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ না করতো তাহলে আমাদের কি অবস্থা হতো? বোধহয় ভাবিনি।
একটা কথা একবার একটু ভেবে দেখবেন সবাই দয়া করে। মানুষগুলো স্বজন, ভিটেমাটি, জন্মভূমি ছেড়ে হাজার মাইল দূরে পড়ে থাকে। এদের প্রিয় মানুষ, প্রিয় জন্মস্থানই তো তাদের সবচেয়ে ভরসাস্থল। আমরা যখন ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়ি, দুর্যোগ, যন্ত্রণার মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হয় পরিবার, প্রিয় মানুষগুলো। মনে হয় কখন ঘরে ফিরবো! সেখানে করোনার মতো মহামারী যখন পুরোবিশ্বে ছড়িয়েছে, তখন এই মানুষগুলো বিদেশে একা পরিস্থিতিগুলো সামলাতে পারেনি। তখন প্রিয়জন, নাড়ির টানে ফিরতে ইচ্ছে হয়েছে নিজের দেশে। এই দেশটা তো তারও, সে তার পরিশ্রমের, মেহনতের অংশ দিয়ে দেশ গড়তে তো ভূমিকা রেখেছে। এই করোনার সংকটকালে সবাই আতঙ্কিত সেটা সত্যি। তারা যদি কোনো নিয়মভঙ্গ করে, অবুঝের মতো কাজ করে বসে তো সেক্ষেত্রে তাদের বোঝাতে হবে। ভয়াবহতা নিয়ে প্রয়োজনে তাদের ব্রিফিং এর মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করুন, নিয়ম মেনে চলতে উদ্ভুদ্ধ করুন, এবং সেটা অবশ্যই সহমর্মিতার মাধ্যমে। খেটে খাওয়া মানুষগুলোর এইটুক বোঝার ক্ষমতা অবশ্যই রয়েছে। তাদের আবেগটাও বোঝার চেষ্টা করুন।
প্রবাসীরা দেশে এলে নবাবজাদা হয়ে যান, তারা কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার বিষয়ে খুব অসন্তুষ্ট হন, ফাইভ স্টার হোটেল না হলে তারা অপছন্দ করেন… একজন শীর্ষপর্যায়ের মন্ত্রী এরকম কথা কীভাবে বলেন? কথাগুলো ন্যাক্কারজনক, আপত্তিকর। খেয়ে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, কখনো মাটিতে ঘুমিয়ে দিনপার করা মানুষগুলো দেশে এসে ফাইভ স্টার হোটেলের কথা ভাববেন কেন! তারা দেশে ফিরেছে শান্তির আশ্রয়ের জন্য, আপনাদের মতো গদিযুক্ত সিংহাসনে বসে উদভ্রান্তের মতো বুলি আউড়ানোর জন্য নয়।
অবিলম্বে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রত্যাহার করা উচিৎ। তাকে মনে করতে হবে যে তিনি রাষ্ট্রের বেতনভূক্ত চাকর, জনগণের সেবা করা তার মুখ্যকাজ, তিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিমাত্র। আমাদের সংবিধানটা একবার দেখুন ভালো করে। সেখানে বলা হয়েছে, এই প্রজাতন্ত্রের মালিক হলো জনগণ। আর যারা অভিবাসী, তাদের অবদান আরও বেশি, তারা অতিথি। দামি বাড়ি, দামি বিএমডব্লিউতে চড়েন, সেখানেও ওই মানুষগুলোর ঘামঝরা অর্থ রয়েছে। সেখানে প্রবাসীদের ‘নবাবজাদা’ বলার ধৃষ্টতা কোথায় পেলেন?

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password