ভাষা আন্দোলনের কথকতা

ভাষা আন্দোলনের কথকতা

ভাষা আন্দোলনের এ ছবিটি এঁকেছি বছর চারেক আগে। তাই ভাবলাম ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখার একটু দুঃসাহস করি। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙ্গালি জাতির জন্যে সবচেয়ে স্মরণীয় ও মহিমান্বিত দিন। ১৯৫২ সালের এ দিনে বাঙ্গালি জাতির সূর্য সন্তানেরা মাতৃভাষার জন্যে প্রাণ দিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দেয়।

যা ভাষা আন্দোলনের মূর্তপ্রতীক হিসাবে সারা বিশ্বে আজ সমাদৃত। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় মূলত ১৯৩৭ সালে। কিন্তু ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ছিল এ আন্দোলনের মূল পর্ব। ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সর্বপ্রথম মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা উর্দু করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।

কিন্তু বাঙ্গালিদের প্রাণের নেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সে দাবির তীব্র বিরোধিতা করেন। এরপর ভাষা নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি ১০ বছরে। কিন্তু ১৯৪৭ এর এপ্রিল মাসে যখন ব্রিটিশরা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে ভারত ও পাকিস্থান নামে আলাদা দুটি দেশ গঠনের পরিকল্পনা নেয় তখনই নতুন করে ভাষা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

পরের মাসে ১৭ মে, ১৯৪৭ মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান হায়দ্রাবাদে এক উর্দুর সম্মেলনে সর্বপ্রথম উর্দুকে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। এর ২ মাস পর জুলাই মাসে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়া উদ্দিন আহমেদও একই দাবি করেন। এর প্রতিবাদে ভাষাবিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ২৯ জুলাই (১৯৪৭) “আজাদ” পত্রিকায় লিখেন, বাংলাই হওয়া উচিত পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা, তবে দুটি রাষ্ট্রভাষা করা গেলে উর্দুর কথা চিন্তা করা যায়। পরের মাসেই ১৪ আগষ্ট (১৯৪৭) জন্ম নেয় পাকিস্থান এবং ১৫ আগষ্ট জন্ম নেয় ভারত।

নতুন রাষ্ট্রের ভাষা কি হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা বাড়তে থাকে। পাকিস্থান সৃষ্টির কিছু দিন পর ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাশেম-এর নেতৃত্বে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়। যার নাম তমুদ্দিন মজলিস। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরই ৬-৭ সেপ্টেম্বর সংগঠনের যুবকর্মীদেরে এক সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে শিক্ষা ও আইন-আদালতের বাহন করার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।

১৫ সেপ্টেম্বর সংগঠনটি একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে, যার নাম হলো “পাকিস্থানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু”। এর লেখক হলেন: কাজি মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমেদ এবং অধ্যাপক আবুল কাশেম। এতে তাঁরা বাংলাকে পাকিস্থানের রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।

এর পর ডিসেম্বর মাসে করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হলে বাঙ্গালি জাতি তীব্র বিদ্রোহ শুরু করে। ডিসেম্বরই (১৯৪৭) তমুদ্দিন নামক সংগঠনটি প্রথম “রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করে। এ পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়্যা। তবে তমুদ্দিন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমই মূখ্য ভূমিকা রাখেন।

সংগঠনটির নেতৃত্বে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ শুরু করে। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে এসব আন্দোলন বন্ধ করতে অপচেষ্টা চালায়। তমুদ্দিন মজলিসের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্থান নামক নতুন রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে ইসলামিক চেতনা শক্তিশালী করা, কিন্তু এটি বাংলা ভাষার পক্ষে ভূমিকা রাখায় ভাষা আন্দোলনের সংগঠন হিসাবেই সমধিক পরিচিতি অর্জন করে।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্থানের গণ-পরিষদের অধিবেশন ইংরেজি ও উর্দুতে শুরু হলে এর সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রতিবাদ জানান। পাশাপাশি বাংলাকে গণ পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি ও প্রচলনের দাবি জানান। গণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করার প্রতিবাদে ছাত্ররা ২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালন করেন।

এ আন্দোলন আরো কার্যকরী করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ২ মার্চ (১৯৪৮) কামরুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে নতুনভাবে গঠন করা হয়। এর নাম দেয়া হয় “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”। নতুন এ পরিষদ ১১ মার্চ বাংলা ভাষা দাবি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ঐ দিন ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে। এ ধর্মঘটে অংশ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ধর্মঘটে ছাত্রদের মিছিল-মিটিং ও পিকিটিং এর সময় পাকিস্থান সরকার বঙ্গবন্ধুসহ ৬৯ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। এতে ছাত্র আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ১৫ মার্চ পর্যন্ত গড়ায়। পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন অবশেষে ছাত্রদের সাথে বসতে বাধ্য হন ১৫ মার্চে। তার পর তিনি ছাত্রদের ৮ দফা দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রূতি দিয়ে আন্দোলনের অবসান ঘটান। কিন্তু তার এ প্রতিশ্রুতিকে তোয়াক্কা না করে মাত্র ৪ দিন পর পাকিস্থানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন (১৯ মার্চ, ১৯৪৮)।

তার পর তিনি ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ঘোষণা দেন যে, “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।” ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনেও তিনি একই ঘোষণা দেন। এতে ছাত্ররা “না,না” বলে প্রতিবাদ জানান। এক পর্যায়ে পাকিস্থান সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ নিয়েছেন। এটি বাঙ্গালিদের সাথে নিছক তামাশা বৈ অন্য কিছুই নয়।

তাই এ হীন উদ্যোগ মেনে নেয়নি বাঙ্গালি দামাল ছাত্র জনতা। এরপর ১৯৪৯ সালে মাওলানা আকরাম খাঁ-এর নেতৃত্বে “পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি” গড়ে উঠে। ১৯৫০ সালে পাকিস্থানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও ঘোষণা দেন পাকিস্থানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু। কিন্তু তিনি ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টবর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্থানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হন।

এর পর তিনি ১৯৫২ সালের ২৬ জানুায়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় নতুন করে ঘোষণা দেন “পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু” । অথচ তিনি পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ১৫ মার্চ, ১৯৪৮ ভাষা সম্পর্কৃত ছাত্রদের ৮ দফা মেনে নিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জিন্নাহকেই অনুসরণ করেন। তার এ ঘোষণা ছাত্রদেরকে অবাক করে দেয় এবং ্ প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ছাত্ররা ধর্মঘট করে।

৩১ জানুয়ারি, ১৯৫২ নতুন করে কাজি গোলাম মাহমুদকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। নতুন করে গঠিত সংগ্রাম পরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচী করে এবং সেখান থেকেই ঘোষণা দেয় ২১ ফেব্রুয়ারিতে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট এবং রাষ্ট্র ভাষা দিবস পালিত হবে। কারাবন্দী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

তিনি ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি কিভাবে পালন করতে হবে তা ছাত্র নেতাদের ডেকে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সরকার তা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু ও সহবন্দী নেতা মহিউদ্দিন আহমেদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুরে পাঠিয়ে দেয়। আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্থান সরকার ঘোষণা দেয় ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। ছাত্ররা তখন কর্মসূচি পালন নিয়ে দুভাগে বিভক্ত হয়েছে। সে দিন রাত শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ে তারা জড়ো হন। তারপর ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে কি না তা নিয়ে ভোটাভুটি হয়।

সেখানে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মাত্র ৪ জন ভোট দেন। আর ১১ জনই ছিলেন এর বিপক্ষে। যে ৪ জন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে ভোট দেন, তারা হলেন: অলি আহাদ, গাজিউল হক, গোলাম মাওলা এবং আব্দুল মতিন। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮), রোজ বৃহস্পতিবার, সকাল ১১ টায় ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা প্রাঙ্গনে (ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে) জড়ো হতে শুরু করে।

ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ছিল তখনকার পরিষদ ভবন। তাই এ ভবনকে কেন্দ্রকে ছাত্ররা তিন দিক থেকে মাইকিং করে স্লোগান দিচ্ছিলো। এক পর্যায়ে ছাত্ররা যখন সামনের দিকে এগুতে লাগলো তখন পুলিশ প্রথমে টিয়ারসেল নিক্ষেপ, পরে নির্বিচারে গুলি করে রফিক (১ম শহীদ), জব্বার, সালাম, বরকতসহ আরো অনেক বাঙ্গালি বীরকে হত্যা করে। পরিষদ সদস্য মাওলানা তর্কবাগিশ ও খয়রাত হোসেন তখন প্রতিবাদ দেখিয়ে পরিষদভবন ত্যাগ করেন আরো কয়েকজনকে নিয়ে।

রক্তের বন্যায় ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়ে গেল, কিন্তু ছাত্ররা থেমে যায়নি। তারা পরের দিন আবারো ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল শুরু করে। সেদিন ২২ ফেব্রুয়ারি আরেকজন শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বীর শফিউর রহমানকেও জীবন দিতে হয়েছে পাক হায়েনাদের নিষ্ঠুর গুলির আঘোতে। বিশ্ব বিশ্ব দরবারে ব্যাপক সমালোচিত হয়ে এবং অদম্য বাঙ্গালি ছাত্রদের দৃঢ় আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালের ৭ মে মুসলিম লীগের সমর্থনে পাকিস্থানের গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়।

এর পর ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্থানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ (১) নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা বলে উল্লেখ করা হয়। সে মহামূল্যবান অনুচ্ছেদটি উল্লেখ না করলেই নয় “The state Language of Pakistan shall be Urdu and Bengali”| ভাষা আন্দোলনের ২১ ফেব্রুয়ারির ইতিহাস পৃথিবীতে নজীরবিহীন।

আর কোনো জাতি মাতৃভাষার জন্যে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছে তা আগে দেখেনি বিশ্ববাসী। তাই এ দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৭ মে, ১৯৯৯ ইউনেস্কোর ৩০ তম সম্মেলনে ১৮৮ দেশের সমর্থনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশ দিনটি উদযাপন করছে। যা নিঃসন্দেহে বাঙ্গালি জাতি ও বাংলাদেশী প্রতিটি মানুষের জন্যে অতি গৌরব ও সম্মানের।

লেখক: মুজাহিদুল ইসলাম নোবেল

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password