কয়লার অভাবে যেকোন সময় বন্ধ হতে পারে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। চুক্তি অনুযাযী, ছয় মাসের বকেয়া ১৫১ মিলিয়ন ডলার বা এক হাজার ছয়শ কোটি টাকা পরিশোধ না করায় কয়লা আসছে না দেশের সবচেয়ে বড় এই কেন্দ্রে। বর্তমান মজুদ দিয়ে ক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন করলেও আর সর্বোচ্চ ১৫ দিন চলতে পারে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিল শোধ করলে কয়লা দেশে আসতে সময় লাগবে ৪০ দিন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পায়রার উৎপাদন বন্ধ হলে ভয়াবহ সংকট হবে। কয়লার পাওনা ডলার পরিশোধে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলছেন তারা।
কয়লার অভাবে দেশের বড় দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র রামপাল ও পায়রা বন্ধ হতে যাচ্ছে। রামপালের মজুত কয়লা দিয়ে বড়জোর এক সপ্তাহ আর পায়রার মজুত কয়লায় বড়জোর দুই সপ্তাহ চালু থাকতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের সংকটের কারণে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বা ঋণপত্র খুলতে পারছে না এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার টাকা ১২ মাস বাকি পড়েছে। ডলার সংকটের কারণে এই অর্থ দেয়া যাচ্ছে না। কেন্দ্র দুটি বন্ধ হয়ে গেলে শীতের মধ্যেই লোডশেডিংয়ে পড়বে দেশ।
এ ছাড়া এখনই এলসি খুললে কয়লা আসতে কম করে হলেও ৪০ দিন লাগবে। আগামী গ্রীষ্মে লোডশেডিং মোকাবিলা করতে সরকার ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে রাখার যে পরিকল্পনা করেছিল তার মধ্যে পায়রা ও রামপাল কেন্দ্র ছিল। এ দুটি কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপদান ব্যাহত হলে দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
দুটি কেন্দ্রের কয়লার মজুত শেষ হওয়ার পথে- বিষয়টি উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আশা করছি দ্রুতই এই দুটি কেন্দ্রের ডলারের জোগান দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সংকট উত্তরণের জন্য আমরা পথ খুঁজছি। সমাধান হয়ে যাবে।’ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবের কথা উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এ সময় তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনও কমিয়ে আনে।
এতে গত গ্রীষ্মে মোট চাহিদার প্রায় ২৫ শতাংশ কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ফলে তীব্র লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে সারা দেশ। তখন বলা হয়েছিল শীতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, আর আগামী গ্রীষ্মের আগেই কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসবে। এতে গ্রীষ্মে লোডশেডিং সামাল দিতে পারবে সরকার। সম্প্রতি কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসা শুরু করলেও এসব কেন্দ্রের বিল ও জ্বালানি খরচ দিতে পারছে না পিডিবি।
কেন্দ্রগুলো বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলারের জোগানও পাচ্ছে না। এমনকি তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোরও তেল আমদানি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশে স্থাপিত বিদ্যুতের ক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে ঘণ্টাপ্রতি গড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। গ্রীষ্মে এই চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় ঘণ্টাপ্রতি ১২ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। রামপাল ও পায়রার কয়লার মজুত তলানিতে বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তীব্র জ্বালানিসংকটে ভুগছে।
রামপালের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিটের মধ্যে ৬৬০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট চালু আছে। এটিতে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন। পিডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে রামপালের মজুত কয়লা শেষ হয়ে যাবে। ডলারের অভাবে রামপাল কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) কয়লা আমদানি করতে পারছে না। এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বর্তমানে ঢাকায় আসছে।
কেন্দ্রটি বন্ধ হলে খোদ রাজধানীতে লোডশেডিং হবে। দেশের ব্যাংকগুলো রামপালকে এলসি খোলার জন্য ডলারের জোগান দিতে পারছে না। দুটি ইউনিটে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের (৬৬০ করে একটি ইউনিটে)। এ কেন্দ্রটি ৬ মাসের বাকিতে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করে। গত জানুয়ারিতে আনা কয়লা আমদানির অর্থ এখনো পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসিএল) পরিশোধ করতে পারেনি।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সমান অংশীদার হলো সরকারের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও চীনের সিএমসি। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, ছয় মাসের বাকিতে ২০২০ সালের ২০ এপ্রিলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার দাম পরিশোধের একটি চুক্তি করে চীনা সিএমসি ও বিসিপিসিএল। কেন্দ্রটিতে কয়লা সরবরাহ করছে পিটি বায়ার্নস। পিটি বায়ার্নসকে নগদমূল্য দিয়ে দেয় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫০ শতাংশের অংশীদার সিএমসি। আর সিএমসিকে ছয় মাস পর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বিসিপিসিএল কয়লার দাম পরিশোধ করে।
ছয় মাসের বাকিতে এভাবেই কয়লা কিনে আসছিল পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। তারা বলেন, গত জানুয়ারিতে কেনা কয়লার দাম গত জুনে দেয়ার কথা থাকলেও চলতি জানুয়ারিতেও বকেয়া টাকা দেয়া যায়নি। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে ১৫১ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা বাকি নির্দিষ্ট সময় দিতে ব্যর্থ হয়েছে পায়রা কর্তৃপক্ষ। দফায় দফায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে দেখা করেও সংকটের সমাধান হয়নি।
এর ফলে গত ১ জানুয়ারি পিটি বায়ার্নস কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। সিএমসি অর্থের জন্য চাপ দিচ্ছে বিসিপিসিএলকে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, ১৫১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১২১ মিলিয়ন ডলার জোগান দিতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু সেটিও হয়নি। ফলে পায়রার মজুত তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এখনি এলসি করার পর কয়লার জাহাজ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে ভিড়তে কম করে হলেও ৪০ দিন সময় নেবে।
এর আগেই কেন্দ্রটির কয়লার মজুত শেষ হয়ে যাবে বলেও তারা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫০ শতাংশের মালিক নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন ও বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এম খোরশেদুল আলম বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগ আমাদের আশ্বস্ত করেছে এলসি খোলার ব্যাপারে।’
এর বেশি কিছু বলতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। গড়ে চাহিদা থাকে ৮ থেকে সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াটের মতো। গ্রীষ্মে এই চাহিদা বেড়ে প্রায় ঘণ্টাপ্রতি গড়ে ১২ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। দেশে বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপিত ক্ষমতা। এর মধ্যে কয়লার অভাবে চালু আছে মাত্র ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালু আছে গড়ে প্রায় ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট আমদানির কথা থাকলেও এখন গড়ে ৬৫০ মেগাওয়াটের মতো আমদানি হচ্ছে।
এ ছাড়া গ্যাসে উৎপাদন হচ্ছে গড়ে ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। সামান্য পরিমাণ আসছে জলবিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুৎ থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। কারণ বাংলাদেশে গ্রীষ্মে চাহিদার একটি বড় অংশ কুলিং লোড বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) ও ফ্যানের পেছনে ব্যয় হওয়া বিদ্যুৎ। এর পরিমাণ ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের মতো।
গ্রীষ্মের শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সেচেও বিদ্যুতের বড় ব্যবহার হয়। বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেলে এর বড় প্রভাব পড়বে দেশের কৃষি ও শিল্প-কারখানায়। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘গত গ্রীষ্মে বলা হলো শীত এলে সংকট চলে যাবে। এখন দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানির জন্য ডলার নেই। এই পরিস্থিতিতে সরকারের অগ্রাধিকার আগে ঠিক করতে হবে। কারণ বিদ্যুতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাশ কাটিয়ে অর্থনীতি বাঁচানো যাবে না।’
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন