মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা

মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা
MostPlay

প্রতি বছর চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত জব্বার মিয়ার বলীখেলা হয়। ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা জেএম সেন এভিনিউ থেকে কোতোয়ালি থানা পর্যন্ত এই মেলার পরিধি। এই মেলার বড় একটি আকর্ষণ মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্রের বিচিত্র সমাহার। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক বিক্রেতা বিভিন্ন রকম জিনিস নিয়ে শহরে হাজির হন। যারা এই মেলায় মাটির জিনিসপত্র নিয়ে আসেন, তাদের সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা এবং বিশেষ করে নবীন প্রজন্ম যেন জানতে পারে, তার উদ্দেশ্য নিয়েই কিছু লেখার চেষ্টা।

প্রত্যেকটি দেশের রয়েছে নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি। একেকটি শিল্পের বিস্তারের পেছনে রয়েছে দেশ বা জাতির অবদান। আমাদের দেশের অন্যতম শিল্প হচ্ছে মৃৎশিল্প। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মৃৎশিল্পের সম্পর্ক অনেক গভীর। ‘মৃৎ’ শব্দের অর্থ মৃত্তিকা বা মাটি আর ‘শিল্প’ বলতে এখানে সুন্দর ও সৃষ্টিশীল বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। এজন্য মাটি দিয়ে দিয়ে তৈরি সব শিল্পকর্মকেই মৃৎশিল্প বলা যায়। প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। আজকাল কুমারপাড়ার মেয়েদের ব্যস্ততা অনেক কমে গেছে। কাঁচামাটির গন্ধ তেমন পাওয়া যায় না। হাটবাজারে আর মাটির তৈজসপত্রের পসরা বসে না। তবে নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনো কিছু জরাজীর্ণ কুমার পরিবার ধরে রেখেছেন বাপ-দাদার এই ব্যবসায়।

মৃৎশিল্পের সঙ্গে চীনের বড় একটা ঐতিহ্য আছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা গেছে চীনের বিখ্যাত শহর থাংশান-এ মৃৎশিল্পের জন্ম হয়েছিল। আর এ কারণেই এ শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। চীনের অন্যতম প্রাচীন শহর পেইচিং থেকে ১৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই শহরটি। এই শহরের পথে-প্রান্তরে, বিনোদন কেন্দ্র বা পার্কগুলোতে মৃৎশিল্পের বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখতে পাওয়া যায়। থাংশানের মৃৎশিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশের সূত্রপাত মিং রাজবংশের ইয়ুং লে-এর সময়কালে। এ শহরের রয়েছে প্রায় ৬০০ বছরের ইতিহাস। এখানে নানা ধরনের চীনামাটির ৫০০টিরও বেশি মৃৎশিল্প রয়েছে। এখানকার বিভিন্ন রকম মাটির মধ্যে প্রাচীন স্থাপত্য চীনামাটি, স্বাস্থ্যসম্মত চীনামাটি, শিল্পায়ন চীনামাটি, হাইটেক চীনামাটি, শিল্পকলা চীনামাটি ইত্যাদি অন্যতম। বিভিন্ন দোকানে গিয়ে অনেক ক্রেতা এখনো চীনের তৈরি জিনিসপত্র খোঁজ করেন।

চীনা শিল্পের যেমন ঐতিহ্য আছে, ঠিক তেমনি আমাদের দেশেরও আছে। শত শত বছর ধরে এই শিল্পের সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ জড়িত আছেন। আমাদের দেশে এই ধরনের কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে আমরা কুমার বলি। অতীতে গ্রামের সুনিপুণ কারিগরের হাতে তৈরি মাটির জিনিসের কদর ছিল অনেকাংশ বেশি। পরিবেশ বান্ধব এ শিল্প শোভা পেত গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে আজ তা হারিয়ে যেতে বসেছে। মাটির তৈরি কলসি, ফুলের টব, সরা, বাসন, সাজের হাঁড়ি, মাটির ব্যাংক, শিশুদের বিভিন্ন খেলনাসমগ্রী নানা ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করত কুমারেরা।

এ শিল্পের প্রধান উপকরণ এঁটেল মাটি, জ্বালানি কাঠ, শুকনো ঘাস, খড় আমাদের দেশে এই শিল্পের ব্যবহার সেই আদিকাল থেকে। পোড়ামাটির নানাবিধ কাজ, গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পুতুল, খেলনা, প্রতিমা, প্রতিকৃতি, টপ, শো-পিসসহ অসংখ্য জিনিস আজও কুমারশালায় তৈরি হয়ে ক্রেতাদের চাহিদা মেটাচ্ছে। কথিত আছে, কাউকে মাটির তৈরি হাঁড়ি কিংবা গণেশের মূর্তি দিলে বিনিময়ে ওই পাত্রে বা মূর্তির পেটে যত চাল ধরে ততটাই দেওয়া হতো শিল্পীকে। মাটির তৈরি বিভিন্ন রকমারি আসবাবপত্র চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি আজ প্রচুর চাহিদা লক্ষণীয়। তাছাড়া মেয়েদের বিভিন্ন মাটির তৈরি গয়না সহজেই চোখে পড়ে দেশের মেলাগুলোতে এছাড়া আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে আজ মাটি দিয়ে প্রস্তুত অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে।

তার পরও অনেক সংগ্রাম করে পোড়ামাটির গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পুতুল, খেলনা, প্রতিকৃতি, শো-পিসসহ অসংখ্য জিনিস কুমারশালায় তৈরি হচ্ছে। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কুমারদের। এ সম্প্রদায়ের লোকজনেরা মাটির তৈরি করা পাকপাতিল, ঠিলা, কলসি, পুতুল, কুয়ার পাট, খেলনার সামগ্রী, ফুলের টব, মাটির ব্যাংক ইত্যাদি হাটবাজারে বা গ্রামে গ্রামে বড় ঝাঁকা বোঝাই করে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। ছয় মাস ধরে তারা মৃৎশিল্প তৈরি করে আর ছয় মাস বিভিন্ন কায়দায় বিক্রি করতেন।

মৃৎশিল্প আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখছে। ২০০০ সালের পর বেড়ে যায় রফতানি। এখন ইউরোপ ও আমেরিকা ছাড়াও নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের পণ্য। রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে ভারত, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। বিদেশে মূলত মাটির তৈরি পামিজ, ফুলের টব, বিভিন্ন ধরনের গার্ডেন প্রডাক্ট, নাইট লাইট, ডাইনিং আইটেম, ইনডোর গার্ডেন আইটেম, ফুলদানি, মাটির টব ও মাটির ব্যাংকের চাহিদা আছে। ব্যাপক ভিত্তিতে মাটির তৈরি জিনিস রপ্তানি করা গেলে আরো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেত।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোর অন্যতম হচ্ছে মৃৎশিল্প। এটি শুধু শিল্প নয়, আবহমান গ্রামবাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। মাটির নান্দনিক কারুকার্য ও বাহারি নকশার কারণে এই শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে যাতে বাইরের রাষ্ট্রে রপ্তানি করা যায় তার জন্য আরো বেশি করে উদ্যোগ নিতে হবে। মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কুমার এবং পালদের সহজ শর্তে ঋণ এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্নমুখী উৎপাদন বাড়াতে হবে। এই দেশীয় শিল্পের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে ।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password