তুলা আমদানিতে ভারত নির্ভরতা থেকে সরে আসছে বাংলাদেশ।

তুলা আমদানিতে ভারত নির্ভরতা থেকে সরে আসছে বাংলাদেশ।
MostPlay
তুলা আমদানিতে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতনির্ভর ছিল বাংলাদেশ। তবে এ চিত্রে পরিবর্তন আসছে। সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, তুলা আমদানির উৎস হিসেবে ধীরে ধীরে ভারতকে প্রতিস্থাপন করছে আফ্রিকার দেশগুলো। বর্তমানে দেশের আমদানীকৃত তুলার এক-তৃতীয়াংশই আসছে আফ্রিকার দেশগুলো থেকে। এর মধ্য দিয়ে দেশে তৈরি বস্ত্র ও পোশাকের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠছে আফ্রিকা।
মূলত মানের কারণেই ভারত থেকে তুলা আমদানি কমিয়ে দিচ্ছেন দেশের সুতা ও কাপড় প্রস্তুতকারীরা। তারা বলছেন, ভারতীয় তুলা থেকে উৎপাদিত কম মানের সুতা ও কাপড় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীরা অভিযোগ তুলছেন। অন্যদিকে আফ্রিকার তুলার মান তুলনামূলক অনেক ভালো। এ কারণে দেশে তুলার উৎস হিসেবে ভারতের জায়গা দখল করে নিচ্ছে আফ্রিকার দেশগুলো।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে তুলা আমদানি হয়েছে ৭৫ লাখ বেল। এর মধ্যে পরিমাণ বিবেচনায় সবচেয়ে বড় উৎস আফ্রিকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মোট তুলা আমদানির ১০ শতাংশ আসে আফ্রিকার বেনিন থেকে। বারকিনা ফাসো ও মালি থেকে আসে যথাক্রমে ৭ ও ৮ শতাংশ। এছাড়া আইভরি কোস্ট ও ক্যামেরুন—উভয় দেশেরই অবদান ৪ শতাংশ করে। সব মিলিয়ে দেশে আমদানীকৃত তুলার ৩৩ শতাংশ আসছে আফ্রিকা থেকে।
মূল্য ও আমদানির সময় বিবেচনায় একসময় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল ভারত। ২০১০ সালে বাংলাদেশ মোট তুলা আমদানি করে ৫২ লাখ বেল। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হয় ১১ লাখ বেলের বেশি। এ হিসাবে সে বছর ২২ শতাংশ তুলা আমদানি হয়েছে ভারত থেকে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ মোট ৬১ লাখ বেল তুলা আমদানি করে। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হয় ২৯ লাখ বেল তুলা। পরের বছর আমদানীকৃত তুলার মধ্যে ভারতের অংশ ছিল প্রায় ৫৫ শতাংশ। বতর্মানে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে আমদানি করা তুলার ১৪ শতাংশ আসছে ব্রাজিল থেকে। একই পরিমাণ তুলা আমদানি হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকেও। এছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে আসে ১৬ শতাংশ তুলা।
সুতা ও কাপড় উৎপাদকদের দাবি, ভারত থেকে যে তুলা আসত তার মান কখনই সন্তোষজনক ছিল না। সে তুলনায় আফ্রিকার তুলার মান অনেক ভালো। গুণগত মান বিবেচনায় নিলে অস্ট্রেলিয়া ১ নম্বর, দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্র ও তৃতীয় অবস্থানে থাকবে আফ্রিকার তুলা। এক্ষেত্রে ভারতের তুলা থাকবে তালিকার ৬ বা ৭ নম্বরে।
অর্গানিক তুলার প্রাপ্যতা ও বেটার কটন ইনিশিয়েটিভ (বিসিআই) সনদের জন্য ভারত থেকে এখনো তুলা আমদানি হচ্ছে। এ দুই বিষয় না থাকলে তুলা আমদানিতে ভারতের অংশগ্রহণ আরো কমে যেত। আফ্রিকার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে। ওই অঞ্চলের কটন অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আফ্রিকার তুলা বাণিজ্য অর্থায়নে বড় ভূমিকা রাখছে দোহাভিত্তিক ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।
তুলা আমদানি বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর পাশাপাশি ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকেও তুলা আমদানি করা হচ্ছে। তুলার মানভেদে সুতার মানেও পরিবর্তন আসে। সে অনুযায়ী তৈরি হয় পোশাক। এক্ষেত্রে ক্রেতা যে মানের পোশাকের চাহিদা দেন, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। হাই-এন্ড বা উচ্চমানসম্পন্ন পোশাকের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও আফ্রিকার তুলা প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে ভারতের তুলার চাহিদা থাকলেও তা স্থানীয় বাজারনির্ভর।
বিসিএর সদস্যপ্রতিষ্ঠানগুলোও বলছে, মূল্য বিবেচনায় নিলেও ভারতের সঙ্গে অনেক বেশি তারতম্য নেই আফ্রিকার তুলায়। এক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে দূরবর্তী দেশ হলেও মান বিবেচনায় গুরুত্ব আফ্রিকার তুলার বেশি। আরেকটি বিষয় হলো ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময়ই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না। মানহীন তুলার কারণে উৎপাদিত সুতা-কাপড়েও সমস্যা রয়ে যায়। এসব এড়াতেও ভারতীয় তুলায় নির্ভরতা অনেকটাই কমেছে।
২০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বেশি হতো। এরপর পরিবহনের সময় ও তুলার দাম বিবেচনায় ভারতমুখী হতে থাকেন আমদানিকারকরা। ওড়িশা ও গুজরাটে উৎপাদিত ভালো মানের তুলার চাহিদা আছে। সেই মান ও প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে পারলে এখনো তুলা আমদানির প্রধান উৎস দেশ হিসেবেই থাকত ভারত। বিভিন্ন সময় দেশের বস্ত্র ও পোশাক রফতানিকারকদের সঙ্গে সনদপ্রাপ্তি নিয়ে ভারতীয় তুলা রফতানিকারকদের বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। তুলা বাণিজ্যে ভারতের মতো অসততা অন্যান্য উৎস দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
তবে আফ্রিকার বাজার থেকে তুলা সংগ্রহে সমস্যাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন তুলা আমদানিকারকরা। তাদের মতে, আফ্রিকা থেকে অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি তুলা কেনা যায় না। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় এ বাণিজ্য হয়। তারা ভারতীয় ব্যবসায়ীদের তুলনায় অনেক পেশাদার। ভারতের চেয়ে ১ থেকে দেড় সেন্ট বেশি দাম হলেও মান বিবেচনায় অনেক ভালো আফ্রিকার তুলা। তবে আফ্রিকা অঞ্চলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখনো উন্নত নয়। ব্যাংক খাত এগিয়ে এলে আফ্রিকার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।
সারা বিশ্বেই ফ্যাব্রিকের গঠন পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে যেখানে ৭০ শতাংশই তুলা ব্যবহার করা হতো, বর্তমানে সেখানে ৭০ শতাংশ কৃত্রিম তন্তু ব্যবহূত হচ্ছে। তুলা আর কৃত্রিম তন্তু ব্যবহার করে একটি টি-শার্ট বানাতে একই সময় লাগে। কিন্তু কৃত্রিম তন্তুর ক্ষেত্রে দাম বেশি পাওয়া যায়। এতে রফতানি মূল্য বেড়ে যায় ২০-৩০ শতাংশ। এক্ষেত্রে নতুন করে কারখানা করার প্রয়োজন নেই। শুধু কিছু উন্নত মানের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। সরকার যদি এ ধরনের ফ্যাব্রিক ব্যবহার করে রফতানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করে, তাহলে সবাই এতে এগিয়ে আসবে। ভিয়েতনাম এগুলো ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও সেদিকেই যেতে হবে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password