রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি এবং টার্ন-এয়ার তৈরি পোশাক শিল্প

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি এবং টার্ন-এয়ার তৈরি পোশাক শিল্প
MostPlay

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে পরিচিত সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির আট বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সেদিনের ওই দুর্ঘটনা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই শিল্প-কারখানা দুর্ঘটনার অন্যতম উদাহরণ হয়ে আছে। বিশ্বের রপ্তানি পোশাকশিল্পে এত বড় ভবনধসে শ্রমিকদের মৃত্যুকূপ একমাত্র বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম। এই ট্র্যাজেডির আট বছর চলে গেলেও আজও গার্মেন্ট শ্রমিকদের মনে শিউরে ওঠে সেই দিনের ওই ভয়াবহ ভবনধসের ঘটনার কথা। বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নানা সময়ে ঘটে যাওয়া ছোট-বড় অসংখ্য আঘাতের মধ্যে রানা প্লাজার ঘটনাটি ছিল ভয়াবহ।

পোশাকশিল্পের ওপর নেমে আসা নানা ধরনের ঘাত-প্রতিঘাতের কথা সামনে এলে প্রথমেই আসে রানা প্লাজার সেই ভয়াবহ স্মৃতি। বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ওই দুর্ঘটনার পর বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে দেশের প্রধান রপ্তানি খাতটিকে। রানা প্লাজা ধসের পর বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি পোশাক বয়কটের স্লোগান ওঠে। পোশাক কারখানাগুলো নিরাপদ নয়, সেই অভিযোগে অনেক বড় বড় ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনা বন্ধ করে দেয়। এমন নানা ধরনের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সামনে এগিয়ে যায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাত। প্রতিকূলতা থাকলেও মোটেও দমে যায়নি বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এরই মধ্যে ভিয়েতনামকে হটিয়ে আবার দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বরাবরের মতো শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে বাংলাদেশের এই শিল্পটি এখন নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানার পাশাপাশি এই শিল্পের উদ্যোক্তারা চাইছেন এক নতুন সুতায় তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে। প্রচলিত তুলার সুতায় তৈরি পোশাকের বদলে মানুষের তৈরি কৃত্রিম বা ম্যান মেইড ফাইবারের তৈরি পোশাক উৎপাদন করে চীনকে পেছনে ফেলে গার্মেন্ট রপ্তানির শীর্ষে ওঠার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ।

বলা বাহুল্য, প্রতিনিয়ত সরকারের উৎসাহ-উদ্দীপনায় এই খাত মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় অর্থনীতির দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের রপ্তানি কমলেও একই সময়ে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ৮৪ শতাংশ। বিজিএমইএর সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য অনুযায়ী মাত্র চার দশক আগে যাত্রা শুরু করে এই শিল্পে এখন তৈরি পোশাকের মোট কারখানার সংখ্যা দুই হাজার ৩০০টি প্রায়। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য এক হাজার ৮৭৪টি কারখানা। উপরন্তু পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের পোশাক খাত। সেই সাফল্যে যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন পালক। গত অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব শীর্ষ দশে স্থান করে নেওয়া ২৭টি শিল্প স্থাপনার মধ্যে ১৪টিই বাংলাদেশের কারখানা।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম ছিল। এই ঘাটতি পুষিয়ে ভারতকে ধরে ফেলেছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি এখন বাংলাদেশ। শুধু রপ্তানি খাত নয়, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানেও এখন এই খাতটি শীর্ষে। করোনা মহামারিতেও বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।

স্বাধীনতার সময় যে পোশাক খাতের কোনো অস্তিত্বই ছিল না, সেই খাতটি এখন দেশের মোট পণ্য রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগ জোগান দিচ্ছে। একসময় বাংলাদেশি পোশাকের মূল বাজার ছিল ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। তবে দেরিতে হলেও প্রচলিত এই তিন বাজারের বাইরেও নতুন বা অপ্রচলিত বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়ছে ব্যাপকভাবে।

৫০ বছর আগের পণ্য রপ্তানিচিত্রের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চেহারাও বদলে দিয়েছে তৈরি পোশাক খাত। পাটকে হটিয়ে পণ্য রপ্তানির শীর্ষস্থান দখল করেছে পোশাকশিল্পটি। পাঁচ দশকের ব্যবধানে রপ্তানি আয় ৯৬ গুণ বৃদ্ধি, প্রায় ৪০ লাখ গ্রামীণ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন, সহযোগী শিল্পের বিকাশসহ অনেক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে পোশাকশিল্প। পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যার দিক থেকেও বিশ্বে সবার ওপরে বাংলাদেশ। করোনার কারণে গত অর্থবছর রপ্তানি কিছুটা কমে এলেও মোট রপ্তানি আয়ের বড় অংশই তৈরি পোশাকের দখলে।

করোনার প্রকোপ শুরুর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১১.৪৯ শতাংশ বেশি। চলতি বছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। করোনার প্রকোপের কারণে সেই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করা কিছুটা কঠিন। তবে করোনা সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁঁড়াতে শুরু করেছে পোশাক খাত। বিশেষ উদ্যোগে এখন তৈরি পোশাক কারখানায় নিরাপদ ও কর্মীবান্ধব পরিবেশে শ্রমিকরা কাজ করছেন। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর আবার ঘুরে দাঁঁড়াতে থাকে রপ্তানি। সরকারের নির্দেশনায় এই সেক্টরটি নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি প্রতিনিয়ত রপ্তানির নতুন বাজার সন্ধান করা হচ্ছে।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির আট বছর পূর্তিতে যে কথাটি বলতে চাই, সেটি হলো রানা প্লাজা ধসের মতো ভয়াবহতাকে মোকাবেলা করে করোনাকালীন এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। কাজেই এই সফলতাকে ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট সব নাগরিকের আন্তরিকভাবে এই সেক্টরের দিকে ইতিবাচক দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত। এতে দেশের পোশাকশিল্প বিশ্বের বুকে আরো উন্নত স্থানে গিয়ে দাঁড়াবে। ফলে দেশের সুনাম এবং এর সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক মানদণ্ড অনেকটা ওপরে উঠে আসবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password