মুরলীধরনকে নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরিতে ভারতে বিতর্ক কেন

মুরলীধরনকে নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরিতে ভারতে বিতর্ক কেন

শ্রীলংকার সাবেক ক্রিকেট তারকা মুথাইয়া মুরলীধরন বলছেন তার জীবন নিয়ে যে চলচ্চিত্র তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে, তা নিয়ে তুমুল বাকবিতণ্ডা এবং প্রতিক্রিয়া হলেও ছবিটি মুক্তি পাবেই। দক্ষিণ ভারতে এই ছবি তৈরি নিয়ে বিক্ষোভ ও বিতর্কের জেরে নাম ভূমিকায় যিনি অভিনেতা ছিলেন তিনি ছবি করবেন না বলেছেন। তার সঙ্গে কথা বলেছেন বিবিসির নলিনী সিভাথাসন এবং ব্যাখ্যা করেছেন কী নিয়ে এই বিতর্ক?

“আমাকে নিয়ে যে কত বিতর্ক হয়েছে, শুধু ক্রিকেটের জগতেই নয়, জীবনের নানা ক্ষেত্রে এত বাধা পেরোতে হয়েছে। যেসব বহু চ্যালেঞ্জের মুখে আমাকে পড়তে হয়েছে, এটা সেগুলোর মধ্যে মাত্র একটা মাত্র,” বলেন ৪৮ বছর বয়স্ক ক্রিকেটার মুরলীধরন।শ্রীলংকার জাতীয় ক্রিকেট দলে জায়গা করে নিতে, দেশটির সংখ্যালঘু তামিল সম্প্রদায়ের সদস্য মুরলীধরনকে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সিংহলী প্রধান শ্রীলংকার নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধের সময় অনেক প্রতিকূলতা পেরোতে হয়েছে।

এরপর, তার বল করার কায়দা নিয়ে ওঠা বিতর্কও তাকে সামাল দিতে হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে খেলার সময় তিনি “অবৈধভাবে বল ছুঁড়ছেন” বা “চাকিং” করছেন এই অভিযোগে তার অনেক বল ‘নো-বল’ ডাকা হয়েছে। এবং পরবর্তীতে তাকে পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে তার হাতের গঠনই ওরকম। তিনি বল ছোঁড়েন না বা চাকিং করেন না। এরপর ক্রিকেটিং দুনিয়া তাকে এ যাবতকালের অন্যতম সেরা ও সফল একজন বোলারের স্বীকৃতি দিয়েছে।

তার জীবন নিয়ে এই বায়োপিকের নাম দেয়া হয়েছে – এইট হান্ড্রেড- টেস্ট ক্রিকেটে ৮০০টি উইকেট নেবার যে রেকর্ডের তিনি অধিকারী, তার থেকেই এই ছবির নামকরণ। আর এই ছবির নির্মাণই সম্ভবত এ পর্যন্ত তার জীবনে সবচেয়ে কঠিন প্রতিবন্ধকতা।ছবির শ্যুটিং এখনও শুরুই হয়নি, কিন্তু তার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় যে অভিনেতাকে নির্বাচন করা হয়েছিল, সেই ভিজয় সেতুপতির ছবি দিয়ে পোস্টার প্রকাশের পর তুমুল ক্ষোভে ফেটে পড়েছে বহু মানুষ।

তামিলনাড়ু জুড়ে ট্রেন্ড করছে হ্যাশট্যাগ #ShameOnVijaySethupathi (ধিক ভিজয় সেতুপতি) অনেকেই দাবি তুলেছে ভিজয় সেতুপতি যেন এই ছবি না করেন।ছবিটির প্রযোজক বলেছেন এটা একজন ক্রিকেটারের “ক্রীড়া জীবনী”, এবং এর উদ্দেশ্য তরুণদের অনুপ্রাণিত করা। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন তাদের আশংকা এটা হবে বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যুতে জড়িয়ে পড়া একজন মানুষকে মহিমান্বিত করে তোলার চেষ্টা।

ক্ষোভের একটা বড় কারণ হল গত বছর শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর এক অনুষ্ঠানে মি. মুরলীধরনের মন্তব্য, যেখানে তিনি ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটায় আনন্দ প্রকাশ করেন এবং প্রেসিডেন্ট পদে গোটাবায়া রাজাপাকসার প্রার্থিতাকে সমর্থন করেন।শ্রীলংকার সরকারি বাহিনী যখন তামিল টাইগার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন গুঁড়িয়ে দিতে এক নির্মম সেনা অভিযান চালিয়েছিল তখন দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন মি. রাজাপাকসা। ওই অভিযানে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

মুরলীধরনের মন্তব্য ছিল, “আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিনটি” ছিল ২০০৯ সালে যখন যুদ্ধ শেষ হল, কারণ দেশ এখন “ভয়ের পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে।”যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অনুমান করা হয় ৪০ হাজার বেসামরিক শ্রীলংকান তামিল মারা গিয়েছিল এবং তামিলনাড়ুর মানুষের কাছে এখনও সেটা হৃদয়বিদারক ঘটনা। তামিলনাড়ুর তামিলরাও ভাষা এবং জাতিগত পরিচয়ের কারণে শ্রীলংকার তামিলদের সাথে একাত্মতা বোধ করে।

”মুরলীধরন একজন তামিল হওয়া সত্ত্বেও, তামিলের মত আচরণ করেন না। আমরা তাকে তামিলনাড়ুতে ঢুকতে দিতে চাই না। সশরীরে নয়, ছবির মাধ্যমেও নয়,” বলছেন ভি প্রভা, চেন্নাইয়ের একজন তরুণ প্রতিবাদকারী।”শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধের সময় মুরলীধরন অনেক দুষ্কর্ম করেছেন, আমরা তাকে তামিল সম্প্রদায়ের নায়ক করে তুলতে চাই না।”তবে মুরলীধরন বলছেন তার বক্তব্যকে বারবার “ঘুরিয়ে” বলা হয়েছে এবং কিসের পরিপ্রেক্ষিতে তা বলা হয়েছে সেটা পরিষ্কার করা হয়নি।

“আমি বলতে চেয়েছি, ২০০৯ সালের পর এ দেশে শান্তি বিরাজ করছে। আমার কাছে যুদ্ধ শেষ হওয়াটা আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন, কারণ শান্তি এসেছে- বেসামরিক তামিল মানুষ মারা গেছেন, সেটা আমার জন্য আনন্দের নয়,” দুবাই থেকে বিবিসিকে বলেন মুরলীধরন। সেখানে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ টুর্নামেন্টের খেলায় সানরাইস হায়দ্রাবাদ টিমের তিনি বোলিং কোচ।

“আমি যুদ্ধের সময় কোন পক্ষ নিইনি- রাজাপাকসার পক্ষ বা অন্য পক্ষ কারোর পক্ষ নিইনি। ভারতের মানুষ জানে না শ্রীলংকায় কী হচ্ছে।”মুথাইয়া মুরলীধরনের ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে, বিশেষ করে তামিলনাড়ুর সাথে। তার স্ত্রী তামিলনাড়ুর। ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত যখন তিনি চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে খেলেছেন, তখন তিনি চেন্নাইয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন । তিনি ছিলেন চেন্নাই সুপার কিংসের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড়।

ছবিটি নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

“২০১০ সালে তামিলনাড়ুর মানুষ জানতেন শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধে তামিলদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, কিন্তু এর সাথে তারা মুরলীধরনের সংশ্লিষ্টতার কথা জানতেন না,” বলছেন মি. প্রভা।“এরপর আমরা একটা প্রচারণা আন্দোলন গড়ে তুলি যেখানে আমরা সবাইকে জানাই তিনি শ্রীলংকা রাষ্ট্রকে কীভাবে সমর্থন করেছিলেন, এবং ২০১৩ সালের মধ্যে আমরা তামিলনাড়ুতে তাকে এবং অন্য শ্রীলংকান খেলোয়াড়দের নিষিদ্ধ করতে সক্ষম হই।”

শ্রীলংকায় তামিলদের মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগের কারণে, তামিলনাড়ু সরকার ২০১৩ সালে আইপিএল গেমসে শ্রীলংকার খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে।চেন্নাইয়ের সাংবাদিক কভিতা মুরলীধরন বলছেন ক্রিকেটার মুথাইয়া মুরলীধরনের বায়োপিক নিয়ে বিক্ষোভ এত তীব্র ও উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কারণ হলো ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনেতা ভিজয় সেতুপতি।

“সেতুপতিকে মনে করা হয় একজন মুক্তমনা অভিনেতা। তিনি অনেক ধরনের সামাজিক ইস্যুতে সরব। কাজেই মুথাইয়া মুরলীধরনের ভূমিকায় অভিনয় করতে তার রাজি হওয়া নিয়ে অনেকেই বিচলিত,” বলছেন তিনি।

“তামিলনাড়ুর মানুষ সিনেমাকে খুবই গুরুত্বের সাথে নেন। সেখানে চলচ্চিত্র শুধু একটা রূপালি পর্দার ছবি নয়। তামিল সিনেমা এবং রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।”কলিউড – যে নামে পরিচিত তামিল চলচ্চিত্র শিল্প- সেই কলিউডের ছবিতে প্রায়ই তামিল জাতীয়তাবাদ ঢুকে পড়ে। রাজ্যের বেশ কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী রাজনীতিতে যাবার আগে চলচ্চিত্র তারকা ছিলেন।

চলচ্চিত্র তারকা এবং রাজনীতিক দুদিক থেকে মি. সেথুপতির ওপর এই ছবির নির্মাণ থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপ এসেছে।কিন্তু মুরলীধরন আকস্মিকভাবে নিজে এই বিতর্কে হস্তক্ষেপ করার পর বিষয়টা একটা ফয়সালা হয়েছে। তিনি নিজেই মি. সেথুপতিকে সরে দাঁড়াতে বলেছেন।

“এই ছবিটা করার জন্য সেথুপতিকে কেন উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নিতে হবে? আমি কেন তার জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াব?” বলেছেন ক্রিকেটার মুথাইয়া মুরলীধরন।

“এটা আমার লড়াই, তার লড়াই নয়। আমার লড়াই আমি লড়ব।”শ্রীলংকায় মি. মুরলীধরন একজন তারকা। সেখানে এই বিতর্ক নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

“আমি তাকে নিয়ে একটা চলচ্চিত্র দেখতে পেলে খুবই খুশি হতাম। এটা তার গুণকীর্তন করার জন্য নয়। কিন্তু তার পরিচিতির যে জটিলতা রয়েছে, তার সবদিক পর্দায় দেখা যেত,” বলেছেন কলম্বোর ক্রিকেট বিষয়ক লেখক অ্যান্ড্রু ফিডেল ফার্নান্ডো। মুরলীধরনের ক্রিকেটিং ক্যারিয়ার নিয়ে প্রচুর লেখালেখি তিনি করেছেন।

“ছবি তৈরির আগেই তা নিয়ে বাকবিতণ্ডা, তা বন্ধ করার চেষ্টা খুবই দুভার্গ্যজনক- ছবিটা কেমন হবে সেটাই যেখানে আমরা জানি না।”যেসব তামিলের পরিবার শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধের সময় নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন, তারাই এই ছবির কট্টর সমালোচনায় নেমেছেন। তাদের কেউ কেউ ছবিটির নির্মাণ পুরোপুরি বন্ধ করে দেবার দাবি জানাচ্ছেন।

ছবিটির যুগ্ম প্রযোজক ডার মোশন পিকচার্স এবং মুভি ট্রেন মোশন পিকচার্স আশা করছিল ২০২১ সালের গোড়ার দিকে তারা ‘এইট হান্ড্রেড’ ছবিটির শ্যুটিং শুরু করতে পারবে। কিন্তু ছবির প্রধান চরিত্রের অভিনেতা সরে দাঁড়ানোর পর সেটা অসম্ভব হবে বলেই মনে হচ্ছে

তবে মুথাইয়া মুরলীধরন বলেছেন তার কাহিনি যে পর্দায় বলা হবে সে ব্যাপারে তিনি আস্থাবান।“এ ছবি হবেই। এ ছবি তামিলনাড়ুর জন্য নয়। ছবির প্রযোজকরা মুম্বাইয়ের। তারা চান সব ভাষায় এই ছবিটি তৈরি করতে, তামিল, সিংহলী, হিন্দি, বাংলা, তেলেগু, মালয়ালম এবং ইংরাজি সাবটাইটেলসহ মূল ছবি,” তিনি বলেন।

“এটা খেলার জগতের ছবি। এটা কীভাবে বিতর্কিত হতে পারে?”

তিনি তেমনটা মনে না করলেও ‘এইট হান্ড্রেড’কে ঘিরে যে তীব্র বিতর্ক দানা বেঁধেছে তাতে এই ছবিতে ক্রিকেট থেকে রাজনীতিকে আলাদা করা কঠিনই হয়ে দাঁড়াবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password