চাল-ডালের লোভে পড়ে অসহায় মিনু কারাগারে’

চাল-ডালের লোভে পড়ে অসহায় মিনু কারাগারে’

হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কুলসুম আক্তার কুলসুমীর বদলে মিনুর কারাভোগের ঘটনায় আগামী ৫ এপ্রিল আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট। এদিকে, আদালতের শুনানিতে উঠে এসেছে মিনুর অসহায়ত্ব ও দারিদ্র্যের কথা। সেখানে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে মূল আসামির প্ররোচনায় চাল-ডালের লোভে পড়ে কুলসুমীর বদলে অসহায় মিনু কারাগারে যেতে রাজি হয়েছিলেন।

এদিকে, শুনানিতে হাইকোর্ট তদবিরকারক কাগজপত্র নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ করেন আপিলকারীর আইনজীবী।

আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ‘আদেশের জন্য আগামী সোমবার রাখছি। এরকম করে ওকালতি হয়? টাউট-বাটপাররা আসবে, আপনারা (আইনজীবী) প্রশ্রয় দেবেন, আপনার কাছ থেকে জোর করে কাগজপত্র নিয়ে গেল, এটাও বিশ্বাসযোগ্য কথা!’

এমন প্রেক্ষাপটে যারা কাগজপত্র নিয়ে গেছেন ও যোগাযোগ করেছেন, তাদের নাম-ঠিকানা-মোবাইল নম্বর আগামী ৪ এপ্রিল, রোববারের মধ্যে হলফনামা আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে আপিলকারী আইনজীবী ইকবাল হোসেনকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

পরে এ বিষয়ে শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ আগামী সোমবার (৫এপ্রিল) আদেশের দিন ধার্য করেন।

আদালতে এদিন মিনুর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী। আর নকল কুলসুমীর পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. ইকবাল হোসেন।

শুনানিতে ইকবাল হোসেন আদালতে বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে আমার কাছে একটি মামলার ফাইল পাঠানো হয়। বলা হয়, একজন দরিদ্র মহিলা কারাগারে বন্দী। তার পক্ষে হাইকোর্টে মামলা করার মতো সঙ্গতি নেই, গরিব মানুষ। এই বিবেচনায় মানবিক কারণে কুলসুমীর পক্ষে হাইকোর্টে আপিল করি। কিন্তু এর কিছুদিন পর আমার বিরুদ্ধে বার কাউন্সিলের একটি আবেদন দেয় কয়েকজন আইনজীবী। এরপর আমার কাছ থেকে কয়েকজন এসে জোর করে মামলার ফাইল নিয়ে যায়।’

তখন আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ‘যখন অনুরোধ শুনল না, তখন মামলা ফাইল করতে গেলেন কেন? এখানে (আপিলে) লিখেছেন সন্তুষ্ট হয়ে। আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। আপনি তদবিরকার, ওকালতনামা রিসিভ করেছেন। তাহলে তো দোষ আপনার ওপরে যায়।’

আদালত আরও বলেন, ‘আপনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। এত খামখেয়ালিভাবে চললে কীভাবে হবে? আপনি যদি সঠিক পথে থাকেন, তাহলে আপনাকে ধরবে কেন?’

তখন ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমি জানতাম না মামলার মধ্যে এত কিছু হয়ে গেছে।’ এ সময় আদালত যারা তার কাছ থেকে ফাইল নিয়ে গেছে তাদের নাম-ঠিকানা জমা দেয়ার জন্য এই আইনজীবীকে নির্দেশ দেন।

এর আগে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য শোনেন আদালত।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী মিনুর মুক্তির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘মিনু নিরপরাধ। একজন নিরপরাধ ব্যক্তি কারাগারে থাকতে পারে না।’

জবাবে আদালত বলেন, ‘নিরপরাধ কী করে হয়? সে তো নিজে নিজেই গলা বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যের হয়ে সাজা খাটতে রাজি হয়ে আদালতে উপস্থিত হয়েছে। জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অভাবের তাড়নায় লোভে পড়ে সেটা এটা করেছে।’

আদালত বলেন, ‘তাহলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এখন কী হবে?’

জবাবে সারওয়ার হোসেন বলেন, ‘আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারেন। একজন অপরাধী জামিন নিয়ে পলাতক হয়ে যাবেন, একজন নিষ্পাপ সাজা খাটবে তা হতো পারে না।’

আদালত বলেন, ‘নিষ্পাপ, সে তো গলা সেধে দিয়েছে। অবশ্য দিয়েছে...।’

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘চাল-ডালের কথা বলেছে। নথিতে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের (৪র্থ আদালত) কাছে তার (মিনু) দেয়া একটি স্টেটমেন্ট আছে।’

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী বিডিটাইপকে বলেন, ‘কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমীর বদলে সাজা খাটার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেছিল মিনু। এই আপিল শুনানির জন্য ওঠে। সেই শুনানিতে মিনু জেনে শুনেই একজনের বদলে কারাভোগের এমন কাজ করেছেন। সেই প্রেক্ষাপটে তিনি আদালতকে বলেন, মনে হয় মিনু খুব অসহায় মানুষ, অভাবে এবং লোভে পড়ে (চাল-ডালের) হয়তো এমন ঘটনা (কারাগারে যাওয়ার মতো) ঘটিয়েছে।’

‘তবে, আদালত আগামী ৫ এপ্রিল আদেশ দেবেন। দেখা যাক।’

কুলসুমীর পরিবর্তে মিনুর কারাভোগের ঘটনা নজরে আসার পর মিনু ও কারা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য শোনার পর চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলার নথি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন গত ২৪ মার্চ। এরপর ৩১ মার্চ বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। এ অবস্থায় বৃহস্পতিবার শুনানি হয়ে আদেশের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে।

জানা যায়, মোবাইল ফোন নিয়ে বিবাদের জেরে চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জ এলাকায় পোশাক কারখানার কর্মী কোহিনুর বেগম খুন হন ২০০৬ সালের ৯ জুলাই। এ ঘটনায় করা মামলায় ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর কুলসুমীকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম আদালত থেকে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্তি পান কুলসুমী। পরবর্তীতে এ মামলায় বিচার শেষে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর রায় দেয় চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। রায়ে কুলসুমীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ রায়ের পর মিনু টাকার বিনিময়ে কুলসুমী সেজে ২০১৮ সালের ১২ জুন চট্টগ্রাম আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেই থেকে তিনি কারাবন্দি।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password