বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর ইসলামপন্থী দলগুলোর নেতাকর্মীরা চরম নির্যাতন চালাচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন প্রচারণার বিপরীতে ফ্যাক্টচেকের মাধ্যমে আল জাজিরা বলছে, ওইসব খবরের পুরোটাই গুজব। আর বিএনপি নেতারা মনে করছেন, শেখ হাসিনার পতনের পর চরম অস্থিরতা সৃষ্টি করতে এসব ভুয়া খবর প্রচার করছে নরেন্দ্র মোদির অনুগত ভারতীয় মিডিয়া।
ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারতের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হতে শুরু করে, বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা ‘ইসলামপন্থী শক্তি’র লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন। বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তু সম্বলিত নিবন্ধ এবং ভিডিওগুলো ভারতীয় মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মজুড়ে প্রকাশিত হয়।
দ্য টাইমস গ্রুপের মালিকানাধীন মিরর নাউয়ের ইউটিউব চ্যানেলে ‘অ্যাটাক অন হিন্দু ইন বাংলাদেশ? ম্যাস মার্ডারস, কিলিংস বাই মব’ শিরোনামে একটি ভিডিও দেখানো হয়। চারটি বাড়িতে সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ফুটেজ দেখানো হয়েছে সেখানে। যার মধ্যে দুটি মুসলিমদের মালিকানাধীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভিডিওটির শিরোনামটি স্পষ্টতই বিভ্রান্তিকর, কারণ এ ঘটনায় কোনো গণহত্যার খবর পাওয়া যায়নি। ভিডিওটিতে অসমর্থিত দাবিও করা হয়েছে, যেমন ‘জনতার হাতে ২৪ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে’ এবং ‘আক্রমণের কেন্দ্রে সংখ্যালঘুরা’।
আল-জাজিরা যাচাইকৃত তথ্য বলছে, সোমবার হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে মাত্র দু’জন হিন্দু নিহত হয়েছেন –একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং একজন হাসিনার আওয়ামী লীগের কর্মী। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে হিন্দুরা প্রায় ৮ শতাংশ এবং ঐতিহ্যগতভাবে তারা আওয়ামী লীগের শক্তিশালী সমর্থক। বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলোর তুলনায় আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষ দল বলে বিবেচনা করা হয়। যদিও তাদের জোটে ইসলামপন্থী দলও রয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জ্যেষ্ঠ নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে উদ্ধৃত করে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘হিন্দুদের ওপর হামলার অনেক সংবাদ প্রতিবেদনে অদ্ভূত দাবি করা হয়েছে, যেমন ‘এক কোটিরও বেশি শরণার্থী শিগগিরই পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করতে পারে’। মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ বার্তা সংস্থা এএনআই ভারতের এক ছাত্রনেতাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘এই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের শত্রুদের দ্বারা পরিকল্পিত’।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটিয়েছে’। মাঠের বাস্তবতা কী? ভারতীয় গণমাধ্যমের এসব প্রতিবেদন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত পোস্টগুলো বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের বাস্তবতার সঙ্গে বিপরীত।
স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সঙ্গে এগুলো সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সোমবার রাত থেকে দেশটির ৬৪টি জেলার মধ্যে ২০টি হিন্দু পরিবারের বেশ কয়েকটি বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়েছে। আল-জাজিরা এসব জেলার কয়েকটি সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছে, হিন্দু বাড়িঘরের ওপর হামলা ধর্মীয় পরিচয় থেকে নয়, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে হয়েছে।
নরসিংদীর মধ্যাঞ্চলের মোস্তাফিজুর রহমান হিরু আল-জাজিরাকে বলেন, তার গ্রামে যে দুটি হিন্দু পরিবারকে টার্গেট করা হয়েছে, সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বসবাস করেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে এই হিন্দু নেতারা অন্যদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছিল বলে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছিল। এখন হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে তারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হচ্ছেন।
ভারতের সীমান্তবর্তী জেলা যশোরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান বাবুল সাহার একটি গুদাম ও বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। যশোরের বাসিন্দা আবদুর রব হায়দার আল-জাজিরাকে বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়া কোনো হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়নি।
রহমান উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ভারতীয় গণমাধ্যমে বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, হিন্দুদের ওপর হামলা ও আইএসআইয়ের কথিত অভিযানের বিষয়ে গুজব ও অযাচাইকৃত দাবি ছড়িয়েছেন। ভারতীয় মিডিয়া আনন্দের সাথে এতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং জয়ের ভুয়া দাবি প্রচার করে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন